Tuesday, April 18, 2017

একে তো পচাভাদ্দর, তালেরও সময়!




বর্ষাকালে বাঙালীর অনেক প্রেমের মধ্যে "তাল প্রেম'ও উথলে ওঠে। এ তাল তালবাদ্যের সাথে যুক্ত নয় কিন্তু মাধ্যাকর্ষণের সূত্র মেনে গাছে পেকে গেলেই তার মুক্তছন্দে পতনের শব্দ যারা পেয়েছে তারা আশাকরি বুঝবে যে তাল পড়ার সে শব্দটা ঠিক কেমন। যাদের তাল গাছ আছে তারা খুব হুঁশিয়ার সে পতনের ব্যাপারে। কারণ সাথেসাথে "ওরে গিয়ে দ্যাখ টাইপ অবস্থা' কারণ তাল কুড়োতে হয় নয়ত তালরসে বঞ্চিত হতে হয়। যারা এই তালের গন্ধ সহ্য করতে পারেনা তাদের অবস্থা খুব সঙ্গীন। যেন ইঁদুর কিম্বা ছুঁচো মরেছে টাইপের। তারা বলবে, কি এমন ফল একটা! তোমরা বাপু তিলকে তাল করতে ওস্তাদ।
আমজাম বাকী ফল গেল রসাতলে, ফাঁকতালে মজতে পারো, প্রেম দেখাতে তালে!

আমি বলি তালেগোলে হরিবোলে উতলধারায় মিশিয়ে দাও তালরস ।

শ্রাবণ-ভাদ্রে দেখা পাওয়া যায় এই তাল নামক সুস্বাদু বর্ষাকালীন ফলটি। যার রসে টইটুম্বুর অন্তর পেরোতে হবে শ্বশ্রুগুম্ফ সম্বলিত এক সত্ত্বাকে সামলিয়ে । তালের বৈশিষ্ট্য এইটাই। বাইরে গোবেচারা ভেতরে সন্ন্যাসী। সেই জটাজুটসমাযুক্তকে বসন শূন্য করতে যাওয়াটাই হল একটা প্রজেক্ট। যত খোলো তত সুতো। যেন চরকার সব সুতোর প্রলেপ তার শরীরে। মনে মনে গেয়ে উঠি "তারে বহু বাসনায় স্ট্রিপ করে যাই, তবুও আঁটির নাগাল না পাই'
তাল বাড়িতে এলে গৃহিণীর দু নয়নে শাওনভাদো । অবস্থা কাঁদো কাঁদো ।

ঘষতি ঘষতি অঙ্গ, পুনঃ তায় দিয়ে পানি,
কাজের মাসী ভাবে বসে...
কখন যে বাপু নিজের ঘরে তাল ছাঁকব তা জানি ?

তালগাছ বিবর্জিত শহরে রবিঠাকুর বেঁচে থাকলে তালগাছ নিয়ে তাঁর কবিতার আবেগ চাপা পড়ে যেত। অথবা ছেলের সম্বন্ধ করতে গিয়ে ঠাকুমা দিদিমারা বলতেন না "নামেই তালপুকুর, ঘটি ডোবেনা' । এমন তালপুকুর দেখেই রবিঠাকুর তালদীঘিতে বুঝি কেয়াপাতার নৌকো ভাসানোর গান লিখেছিলেন।

প্রাচীনযুগের মুনিঋষিরা লিখতেন তালপাতায় খাগের কলম কালিতে ডুবিয়ে। সকলের কাছেই তাঁদের সাহিত্যসৃষ্টির হার্ডকপি ছিল এই ভূর্জ্যপত্র।

ভাদ্রমাসে শুক্লা নবমী তিথিতে অনেক মহিলা "তালনবমী' ব্রত করেন । নারায়ণকে নিবেদন করে তবেই তাল খাওয়ার রীতি। এই তালনবমীর ব্রতকথা যেন টেলিভিশনের মেগা সিরিয়ালের মত‌ই । শুধু কুশীলব হলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ আর তাঁর দুই প্রিয়তমা সপত্নী...সত্যভামা ও রুক্মিণী। তালের রসে স্বামীকে বশীকরণ । ঐ আর পাঁচটা মত‌ই এর সুফল হল সৌভাগ্য লাভ, সুখবৃদ্ধির মত‌ই। তবে এয়োস্ত্রীরাই কেবল করতে পারবেন কেন তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সংশয়। জগত সংসারে কি তবে যত দুঃখ এদেরি ? বাকী আইবুড়ো, বিধবা কিম্বা নিঃ সন্তান অথবা সিঙ্গল মাদারদের কি সুখ, সৌভাগ্যের প্রয়োজন নেই?

শ্রীকৃষ্ণের হ্যাপি বার্থডের পরদিন নন্দোত্সবে ভক্তরা আনন্দে নাচতে থাকে আর গেয়ে ওঠে..."তালের বড়া খেয়ে নন্দ নাচিতে লাগিল'

এ যেন ঈশ্বরের সাথে একাত্ম হয়ে তাঁর প্রিয় ফলটি নিবেদনের মধ্যে দিয়ে ভক্ত আর ভগবানের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করা। তাঁর জন্মদিন যেন আমাদের ঘরের ছেলেরি জন্মদিন।

হে কৃষ্ণ করুণাসিন্ধু ! তালের বড়া দিতে পারি, যদি পার কর এই ভবসিন্ধু।
হ্যাপি বার্থডে অন্তর্যামী ! তালের বড়া সাজিয়ে দিলাম, এবার খাবেন আমআদমী !

এই তালের বড়াকে অনেকে তালের ফুলুরিও বলেন। রসরাজ অমৃতলালের লেখায় পাই এই তালফুলুরির কথা।

তালফুলুরির তত্ত্বে করিয়া জমক, ধার্য হল লোক মাঝে লাগাবে চমক।

কথায় বলে না ? ও তাল তুলনি বাপু! যার অর্থ হল তাল বাড়িতে এলে যা হ্যাপা সামলাতে হয় তা যিনি সামলান তিনিই জানেন।
এমনকি রসরাজ বলছেন, বেশী তালের বিপদ।
ফুলুরি খাইলে যদি পেটে ধরে ব্যথা, পেপারমেন্টো দিতে হবে নাহিক অন্যথা।

এর থেকে বোঝা যায় বাঙালীর সেযুগে তালবিলাসের কথা।

আমি বাপু বড় তালকানা। তালকাহন নিয়ে টালবাহানা না করে লিখে দিলাম। আমি তেমন কোনও তালেবর নই। যে কথা জানিনা আর শুনিনি তা নিয়ে তিল থেকে তাল বানাতে পারিনা তাই মাফ চেয়ে নিলাম পাঠকের কাছে। আকাশ পাতাল ভেবে তালের গন্ধে মাতাল হয়ে তাল নিয়ে সাতকাহন লিখলাম। এবার দাঁতাল কোনও পাঠক যদি নিন্দে মন্দ করেন তাকে নাহয় রেঁধে খাওয়াতে পারি এই তাল। আমার হেঁশেলে আজ হরতাল। দিনেরাতে সকলেই খাবে শুধু তাল।

যাই দেখি আমার চাতালে তাল ছাঁকার সুগন্ধে বুঝি হরিতাল পাখিটা এয়েচে! যদিও বেতালে ডাকছে তবুও আমি তাল দিয়ে চলি ওর সাথে। 

গুরু না ভজিলে


কাল সকাল বন্ধু রমেনকে ফোন করতে গিয়ে কলারটিউনটা শুনেই মাথাটা গরম হয়ে গেল কর্তার
"দিন তোমার আনন্দে যাবে জপলে গুরুর নাম....ভাই জপো, জপো গুরুর নাম, জপো জপো গুরুর নাম..." একবার, দুবার, বহুবার.....যেন শুনিয়েই ছাড়বে  গুরুবন্দনা। 

টেলিভিশন চ্যানেলে সঙ্গীতশিল্পীরা গান শুরু করার আগে গুরুর নাম করেই সর্বাঙ্গ ছুঁয়ে ক্ষমাপ্রার্থী আজ। কেন রে বাবা? এই গুরুমুখী বিদ্যের জন্য ভারতবর্ষের আর কিছুই হচ্ছেনা আর। নতুন কিছু কর বাপু! গুরুশিষ্য পরম্পরায় পড়ে থাকলে নিজের ক্রিয়েটিভিটির পরিস্ফূরণ হবেনা দেখিস। কর্তার ভারি রাগ হচ্ছে। মাঝেমাঝেই গিন্নীর পানে ছুঁড়ে দিচ্ছেন এক আধটা ক্রোধ-ফুলকি! 
সারা দেশের আনাচকানাচে আজ একটাই সুর ......
 "গুরু ব্রহ্মা, গুরু বিষ্ণু, গুরুর্দেব মহেশ্বর, গুরু সাক্ষাত পরমব্রহ্ম তস্মৈ শ্রী গুরবে নমোহঃ"
...একেই ঈদ, রথযাত্রা, বিপত্তারিণীর কৃপায়  মাগ্যিগন্ডার ফলপাকড়ের বাজারটা সবে একটু কমতির দিকে....তারপরেই গিন্নীমায়েরা ছুটলেন আবার বাজারে....গুরুপূর্ণিমা বলে কতা ! সেই কবে দীক্ষে দিয়ে গুরু গিন্নীর জেবনটাই বদলে দিলেন গো! 
গিন্নী পরম ভক্তিতে গুরুর পুজো করছেন আজ।  একপ্রস্থ হবে বাড়িতে, বাকীটুকুনি হবে গুরুর আশ্রমে। রীতিমত জম্পেশ পটলাক পার্টি।
ঠাকুরঘর থেকে ভেসে এল গানের সুর..

শিষ্য মেলে কতশত, গুরু মেলে একজনা,
সেই গুরুর চরণ পেলে পাপীর দেহ হয় সোনা.....

-বোঝো কান্ড! তাহলে আমাকে বিয়েশাদী কল্লে কেনো? কর্তা বল্লেন গিন্নীকে। 
গিন্নী আবার গেয়ে উঠলেন..

গুরু ব্রহ্মা, গুরু বিষ্ণু, গুরু মহেশ্বর
গুরুতত্ব জেনে তবে আসল গুরু ধর
গুরু আমার পথের আলো,
তাঁরে সব সঁপে দেনা !

কর্তা এবার ঝেঁঝে উঠে বল্লেন,
-তাহলে থাকো তোমার গুরুকে নিয়ে। আর শোনো, আমার ঐ মাথার ঘাম পায়ে ফেলা টাকাগুলো দিয়ে গুরুসেবা এবার বন্ধ করো দিকিনি।  ফিবছর আষাঢমাসের এই দিনটাতে গুরু গুরু করে এক্কেরে দরদ উথলে উঠছে। ধম্ম কচ্চেন তিনি! গৃহধর্মটা ঠিকঠাক পালন করোতো বাপু। আমার মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে এলাম।আর উনি পড়ে র‌ইলেন কিনা গুরু নিয়ে।
ভুরি ভুরি মিথ্যে কথা বলছ্, মানুষের মনে দুঃখ দিচ্ছ, অন্যকে ঈর্ষা করছো, ঠিক দীক্ষা নেবার আগে যেমন করতে, তাহলে দীক্ষা নিয়ে কি হল বাপু?  বলি গুরু তোমার কি উন্নতি করলো শুনি? 

গিন্নী নাক টিপে গুরুর দেওয়া একশোআট রুদ্রাক্ষের মালাটা  গলায় ঝোলানো জপের ঝুলি থেকে আদ্দেকটা বের করে নাম জপ করছিলেন। তাই কথা বলা বন্ধ তার। শুধু আড়চোখে দেখে নিলেন কর্তার দিকে একটিবার। 
কর্তা বল্লেন,
-প্রথমে  সংস্কৃত স্তোত্র দিয়ে গুরুবন্দনা হল। তারপর গুচ্ছের গান গেয়ে গুরুস্তুতি হল, এবার শুরু হল নাক টিপে গুরুর নাম জপা।  আজ আবার তেনার উপোস। তাই আমারো কপালে ভাত ডাল জুটবেনা। উনি গুরুর আশ্রমে যাবেন প্রসাদ পেতে আর আমি পাঁউরুটি খেয়ে আপিস করব সারাটাদিন। আর আমার পয়সায় গুরু গিলবেন চর্ব্য-চূষ্য-লেহ্য-পেয়!
...মাখন দিয়ে মিছরি, কাগচি বাদাম, পাথরের গেলাসে দৈযের ঘোল, পাঁচরকম সেরা ফল যেমন বেদানা( আমার বড়োই বেদনা হয় দাম শুনে), ঋতুশেষের মহার্ঘ্য আম( শালা নিজে খাইনা আর), কাশ্মীরি আলুবখরা( চেখে দেখলামনা আজো), আরবী খেঁজুর( দানা ছোট বলে নাকি স্বাদে অতুলনীয়), কালো আঙুর( গুরুদেবের নাকি রক্তাপ্লতা আছে, প্রায়শ‌ই উপোস করে থাকেন তো)!
সেই সঙ্গে উত্কৃষ্ট সব মিষ্টান্ন। সেনমশাইয়ের "বাবুসন্দেশ", যাদবচদ্র দাসের "আবার খাবো", ভীমনাগের "রাতাবী", যুগলের "দিলখুশ", বলরাম মল্লিকের "জলভরা", অমৃতের পয়োধি, মহাপ্রভুর কেশর রাবড়ি....আরো কত কি! 

-গুরুপূর্ণিমে পালন হচ্চে! গুষ্টির তুষ্টি হচ্চে! সংসারটা ঠিকমত করো দিকিনি। তা না সারাবছর গুরুভাইবোনেদের সাথে আজ এখানে, কাল সেখানে যাচ্চি, ফূর্তিফার্তা করচি আর সংসারধর্ম চুলোয় দিচ্চি। স্বামী রোজ বিকেলে বাড়ি ফিরে তেনার কাপড় তুলছেন বারান্দা থেকে। নিজে চা করে খাচ্চেন সারাদিন পর আর খিদে পেলে সেই একগ্গাল মুড়ি চিবিয়ে পড়ে আচেন। আর উনি কচ্চেন ধম্মকম্মো! নিকুচি করেচে!  শ্বশুরশাশুড়িকে জম্মে দিলনা দানাপানি আর গুরুর পুজোয় রূপোর রেকাব, ফলের ঝুড়ি, সাজিয়েগুছিয়ে চল্লেন উনি!  

গুরুসেবা কত্তে। ধম্ম যেন ফ্যাশন হয়েছে এখন। কোথায় গুরু লেকচার দিচ্ছেন্, ছোট, ছোট সেখানে। দরকার হলে গাড়ি ভাড়া করে হৈ হৈ করে এক দঙ্গল নিয়ে ছোট। কোথায় গুরুর ত্রাণ তহবিলে চাঁদা তুলতে হবে, সব কাজ শিকেয় তুলে পাড়ার দোরে দোরে ঘোর....কি না, গুরুর কৃপা দৃষ্টি পেতে হবেনা! না পেলে মোক্ষলাভ হবেনা যে! 

এত্তসব সলিলকি আওড়ে কর্তার মনে হল গিন্নীকে আজ একটা দাওয়াই দিয়েই ছাড়বেন তিনি। হঠাত মনে পড়ল তার নিজের মায়ের কাছে শোনা গুরুপূর্ণিমার বেত্তান্তের কথা। গিন্নী পুজোর ঘর থেকে বেরোলেই কর্তা তাকে জিগেস করে বসলেন
"আচ্ছা, এত তো গুরুপূর্ণিমার জন্য প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে, জানো কি আসলে গুরুপূর্ণিমাটা কেন পালন করে? "
গিন্নী বলল, জানতাম, ভুলে গেছি।
কর্তা বলল, জানতেও না, জানবার চেষ্টাও করোনি কোনোদিনো। ধর্মপালন নিয়ে পুতুল খেলা করলে কি আর জ্ঞান বাড়ে?
গিন্নী বলল, বাজে কথা রাখো। আমার আজ আশ্রমে যেতে হবে। তার আগে জলখাবার বানাতে হবে।
কর্তা বলল, তোমার তো উপোস আর আমার তো বরাদ্দ চা-পাঁউরুটি আজ। 
গিন্নী বলল, লুচির ময়দা মাখতে হবে, যেতে দাও।
কর্তা বলল, "যাক তবে, গুরুর জন্যে আজ তবু বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে। জামাইয়ের জন্য মারি হাঁস, গুষ্টিশুদ্ধ খায় মাস" 
গিন্নী বলল, আশ্রমে পেসাদ পেতে অনেক বেলা হয় যে। বাবার ভোগ নামবে তবে তো খাব সকলে।
কর্তা বলল, যাক এমন ভোগ যেন প্রতি বছর অনেক দেরী করেই নামে।

কর্তার মনটা একটু খুশ হল অনেকদিন বাদে জলখাবারে লুচির কথা শুনে...জানো গুরুপূর্ণিমা আসলে কার হ্যাপি বার্থডে?
গিন্নী বললে, সে জানি, মহাভারতের রচয়িতা মহর্ষি ব্যাসদেবের , তাই তো এর আরেক নাম ব্যাসপূর্ণিমা। কর্তা বললেন, ভেরি গুড, আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ ডিয়ার!  কিন্তু  আমার খুব আপত্তি এতে।
গিন্নী বলল, কেন শুনি?
আরে যিনি রক্ষক তিনি‌ই ভক্ষক যে।
মানে?
মানে, মহাভারত নিজের গুষ্টির কাজিয়া তাই তিনি ছাড়া আর কে এমন ভালো করে জানবেন তার কাহিনী? তাই তো তিনি অত গুছিয়ে লিখতে পেরেছিলেন। নয়ত অত চরিত্র নিয়ে অমন একটা মহাউপন্যাস কেউ সহজে লিখতে পারে বলো? 
গিন্নী লুচির ময়দা ঠাসতে ঠাসতে বলল, নিজের গুষ্টি বললে কেন?
কর্তা বলল,  
মহাভারতের গ্রন্থকার প্রবাদপ্রতিম পুরুষ কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ ব্যাসদেব  ছিলেন মহর্ষি পরাশর এবং মৎস্য কন্যা অবিবাহিতা সত্যবতীর অবৈধ সন্তান । আর গঙ্গার মৃত্যুর পর ব্যথিত, পথক্লান্তিতে পরিশ্রান্ত রাজা শান্তনু যখন সত্যবতীকে বিয়ে করতে চাইলেন  তখন  সত্যবতীর একমাত্র শর্ত ছিল এই যে, শান্তনু এবং তার প্রথমা পত্নী গঙ্গার পুত্র  দেবব্রত ভীষ্ম কোনো দিনও যেন বিবাহ না করেন । তাহলে সত্যবতী এবং শান্তনুর বংশধরেরাই হবে ঐ রাজবংশের উত্তরসুরী ।  আর কারো কোনো দাবী দাওয়া থাকবে না।  ভীষ্ম তাই ছিলেন চির কুমার ।   কিন্তু অচিরেই যখন শান্তনুর মৃত্যু হল এবং সত্যবতীর সোনার সংসারে নেমে এল একরাশ অসহায়তা তখন সেই ভীষ্মই হলেন রাজমাতা সত্যবতীর আজ্ঞাবহ দাস । কত বড়  সুযোগসন্ধানী এই মহিলা !
শান্তনু-সত্যবতীর দুই পুত্র হল চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য । শান্তনু অকালে মারা গেলে প্রথমে চিত্রাঙ্গদ ও তার মৃত্যু হলে বিচিত্রবীর্য সিংহাসন আরোহণ করলেন । নাবালক বিচিত্রবীর্যের জন্য পাত্রী সেও সংগ্রহ করে এনে দিলেন ভীষ্ম ।  কারণ সত্যবতীর হুকুম আর সেই বংশরক্ষার ছড়ি । দুই পত্নীর ভর্তা হয়েও বিচিত্রবীর্য যখন অকালে প্রাণ হারান তখন  সেই দুই পুত্রবধূর গর্ভসঞ্চারের জন্য সত্যবতী ভীষ্মকে লোকদেখানো একটা অনুরোধ করলেন ঠিকই কিন্তু হার মানলেন পুরুষ সিংহের প্রতিজ্ঞার কাছে । বরং ভীষ্মই তাকে পরামর্শ দিলেন সে যুগের রীতি অনুযায়ী ক্ষেত্রজ পুত্রোত্‌পাদনের কথা বলে ।  সত্যবতীর কুমারী জীবনের পুত্র সেই ব্যাসদেবকেই আহ্বান করা হল বীজ বপনের জন্য ।পুত্রও প্রস্তুত বীজ বপনের জন্য মাতৃ আজ্ঞা নিয়ে আর  দুই বিধবা পুত্রবধূর উর্বর ক্ষেত্রও প্রস্তুত মাতৃত্বের হাহাকার নিয়ে ।অতএব  ব্যাসের ঔরসে বিচিত্রবীর্যের দুই পত্নীর ধৃতরাষ্ট্র এবং পান্ডু নামে দুটি প্রতীবন্ধী পুত্রের জন্ম হল । শোকার্ত দুই পুত্রবধূর ওপর শ্বশ্রুমাতা সত্যবতীর আরোপিত এই আদেশ নিন্দনীয় হলেও সত্যবতীর স্বীয় বংশ বিস্তারের খিদে তো মিটলো ! সেদিক থেকে বিচার করলে শান্তনুর রক্ত কিন্তু টিঁকে র‌ইল না ।  কৌরব-পান্ডব উভয়পক্ষের সাধারণ প্রপিতামহী রাজমাতা সত্যবতীর অবৈধ সন্তান মহর্ষি ব্যাসদেবের সেই রক্তস্রোত  প্রবাহিত হল মহাভারতের দুই নায়ক ধৃতরাষ্ট্র ও পান্ডুর মধ্যে দিয়ে।  যদিও ব্যাসদেব তার মাতা সত্যবতীর কানীন পুত্র তবুও বংশরক্ষার দায়িত্ববান পুরুষ হিসেবে মহাভারতে তার অবদানকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই ।
ব্যাসদেবের কুত্‌সিত চেহারার জন্য বিচিত্রবীর্যের দুই পত্নীর দুটি প্রতিবন্ধী পুত্র হল ঠিকই কিন্তু  যদি তারা আবার বংশরক্ষায় সক্ষম না হন সেই কথা ভেবে রাজবাড়ির দাসীর গর্ভ সঞ্চার করলেন ব্যাসদেব । ফলে জন্ম নিলেন সুস্থ দাসীপুত্র বিদুর যার পিতামহীও স্বয়ং সত্যবতী ।  বিচিত্রবীর্যের দুই পত্নীর দুটি প্রতিবন্ধী পুত্রের পিতা ব্যাস কিন্তু কখনো নিজেকে তাদের পিতা বলে পরিচয় দেন নি । কেননা তারা তো বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রজ । কিন্তু এই দাসীপুত্র বিদুরের পিতা তো মহর্ষি ব্যাস । তাই রাজপুত্র দ্বয়ের চেয়ে দাসীপুত্রের ওপরই ছিল তার অগাঢ় অপত্য স্নেহ । মহাভারতের পাতায় পাতায় আমরা ব্যাসদেবকে মহামতি বিদুরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে দেখেছি । ব্যাসদেব স্বয়ং মহাভারতের রচয়িতা বলেই বোধ হয় তাঁর এরূপ পক্ষপাতিত্ব । আর কুন্তীর ক্ষেত্রজ সন্তানদের মধ্যে যুধিষ্ঠির যে ঐ বিদুর বা ধর্মপুত্র তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।  
বিশেষত যুধিষ্ঠিরকেই তিনি সর্বোত্তম বলে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন । এর কারণ একটাই ; পান্ডুর সবকটি ক্ষেত্রজ সন্তানের মধ্যে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের পিতা ছিলেন ধর্মপরায়ণ ন্যায়নিষ্ঠ বিদুর ব্যাতীত আর কেউ নন সেটা অন্যদের কাছে গোপন থাকলেও সত্যবতী, কুন্তী আর বিদুর ছাড়া ব্যাসদেব নিজে যে জানতেন সে কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা ।   আর সেই জন্যই যার হাতে র‌ইল কালজয়ী ইতিহাস রচনার কলম  তিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জেতাতে চাইলেন সেই পান্ডবদের । প্রতিষ্ঠা করলেন  যুধিষ্ঠিরের আদর্শবাদ আর সত্যবাদীতাকে ।
ব্যাসদেবের কলমের কারসাজিতে পাঠক বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছেন  যে ধৃতরাষ্ট্রকে সত্‌পরামর্শ দিয়ে ঠিক পথে চালিত করছেন এই ন্যায়নিষ্ঠ দাসীপুত্র । কিন্তু আসলে  পক্ষপাত দোষেদুষ্ট এই বিদুর নামের রাজনীতিবিদের সম্মোহনী শক্তিতে পরাস্ত হয়েছেন ধৃতরাষ্ট্র । এ যেন "চোরকে বলে চুরি করো আর গেরস্তকে বলে সাবধান হও" এই ভাবে ধীরে ধীরে মহারণের দাবার ঘুঁটিকে পাকাপোক্ত ভাবে নিজের দিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা ।  লক্ষ্য একটাই ; নিজের পুত্র যুধিষ্ঠিরকে সিংহাসনে বসিয়ে দেওয়া ।
অতএব এবার তোমার ক্লিয়ার হল তো ব্যসদেব স্বয়ং নিজের গুষ্টির গল্পটা কেমন ফেঁদেছিলেন ঐ মহা-উপন্যাসে? 
যাও যাও গিন্নী, আজ একটা বিশাল বার্থ-ডে কেক নিয়ে যাও তোমার গুরুর জন্য!!!  ভারতবর্ষের আদিগুরুর জন্মদিন বলে কতা! 

Wednesday, April 12, 2017

স্বর্গীয় রমণীয়ঃ নীল ষষ্ঠী

স্বর্গীয় রমণীয় ()
নীল
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

মহাদেবের নীলের পুজোর দিনটা বরাদ্দ চড়ক বা গাজনের দিনক্ষণ অনুযায়ী, বর্ষশেষের সংক্রান্তির আগের দিনে। প্রতিবছর এই নিয়ে দুগ্গার সঙ্গে শিবের বেশ ঠান্ডা লড়াই চলে। দুর্গা ও ষষ্ঠীর অংশ, সে কথা কে আর না জানে? আর শিবের ফন্দীও কি দুগ্গার জানা নেই?
হঠাত দুগ্গা বলল, 'দিন আগেই তো ঠান্ডায় ঠান্ডায় শিবরাত্তিরে মহা ধূমধাম করে কত্ত পুজো পেলে । ফাগুনদিনের মাগ্যির বেলের পানা, তরমুজ, ফুটি খেয়ে পথ্যি করলে। সিদ্ধি-মধু-ঘিয়ের ফেসপ্যাক নিলে । ডাবের জলে মুখ আঁচালে । ঠান্ডার পর নতুন গরমে কাগচীলেবুর সুবাস ছড়ানো টক দৈয়ের ঘোল খেয়ে ব্যোম্‌ ব্যোম্‌ করে ত্রিভুবন শান্তি কল্লে । মাথা ঠান্ডা তো তোমার গুরু! আবার নীলষষ্ঠী ? ষষ্ঠী তো এতদিন জানতাম একবগ্গা মেয়েদের সম্পত্তি। এবার সেখানেও ভাগ বসালে তো আমাদের ব্র্যান্ড ডাইলুশান হয়।

শিব বলল, নিজের আত্মতুষ্টিতে বিভোর তুমি। জানবে কি করে প্রজারঞ্জনের মাহাত্ম্য?
আবার ষষ্ঠীর পেছনে নীল জোড়া কেন বাপু? ক‌ই আমরা তো লাল,সবুজ, হলুদ ষষ্ঠীর দোহাই দি‌ই না মানুষকে।
পাশ থেকে সাওকড়ি মেরে নন্দী বলল, মা ঠাকরুণ তো ঠিক‌ই বলেচে বাবা।
নীলষষ্ঠী নীল কেন ? লাল বা সবুজ নয় কেন?
নীল কথাটি নীলকন্ঠ মহাদেবের সাথে সাযুজ্য রেখে... এতদিন আমার কাছে আচিস এটাও জানিস নে? মহাবাবা বলেন । সেই যে সেই সমুদ্রমন্থনের সময় আমি দুনিয়ার সব বিষ আমার কন্ঠে ধারণ করেছিলাম । তাই তো সকলে আমাকে নীলকন্ঠ বলে ডাকে রে ।
তার সঙ্গে ষষ্ঠী জুড়লো কে বাবা ? নন্দী বললে
তাহলে শোন্‌ বলি: মহাদেব শুরু করলেন।
এক বামুন আর বামনীর পাঁচছেলে আর দুটি মেয়ে । ( ফ্যামিলি প্ল্যানিং তো আর ছিলনা সে সময়ে )
তারা খুব পুজোআচ্চা করত । কিন্তু এত পুজো, বারব্রত করেও তাদের সব ছেলেমেয়েগুলো একে একে মরে গেল । তখন বামনীর ঠাকুরদেবতায় বিশ্বাস চলে গেল । তাদের আর সেই জায়গায় থাকতেও ভালো লাগল না । বামুন-বামনী ঠিক করল সব ছেড়েছুড়ে তারা মনের দুঃখে কাশীবাসী হল । দশাশ্বমেধ ঘাটে স্নান করে অন্নপূর্ণার পুজো করে মণিকর্ণিকার ঘাটে বসে আছে , এমন সময় মা-ষষ্ঠী বুড়ি এক বামনীর বেশে এসে বললে " কি ভাবছ গো মা?" বামনী বললে " আমার সব ছেলেমেয়েদের হারিয়েছি । এত পুজোআচ্চা সব বিফলে গেল আমাদের । সব অদৃষ্ট। ঠাকুর দেবতা বলে কিছ্ছু নেই । "
ষষ্ঠীবুড়ি বললেন " বারব্রত নিষ্ফল হয়না মা, ধর্মকর্ম যাই কর ঈশ্বরে বিশ্বাস চাই । তুমি মা-ষষ্ঠীকে মানো? তাঁর পুজো করেছ কখনো? তিনি সন্তানদের পালন করেন । বামনী বললে " আমি এযাবতকাল সব ষষ্ঠী করে আসছি কিন্তু তবুও আমার ছেলেরা র‌ইল না ।
ষষ্ঠীবুড়ি বললেন্" তুমি নীলষষ্ঠীর পুজো করেছ কখনো? চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন উপোস করে শিবের পুজো করবে । শিবের ঘরে বাতি জ্বেলে জল খাবে । সন্তান্‌দের মঙ্গলকামনা করবে' (স্পিরিচ্যুয়াল গুরুদের ব্ল্যাকমেইলিংয়ের একটা লিমিট থাকে, তখন ছিলনা)
বামনী সেই কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে পুনরায় মাতৃত্ব লাভ করলে ।

নন্দী সব শুনে বললে" বাবা, এ তো তবে তোমার নিজের ব্র্যান্ড ক্রিয়েট করলে তুমি । আর সব ষষ্ঠীর পুজোয় তো মাষষ্ঠীর পাল্লা ভারী হয়ে যাচ্ছিল তাতে যদি তোমার নামডাকে ভাটা পড়ে তাই বুঝি এমনটি কল্লে তুমি?'
মহাবাবা বললেন " দেখ নন্দী, এখন যা যুগ এয়েচে তাতে নিজের ব্র্যান্ড যে মূল্যেই হোক ক্রিয়েট করতে হবে । নয়ত তুই স্থান পাবিনা জগতে , যা কম্পিটিটিভ মার্কেট এয়েচে! লাখলাখ দেবদেবীর ভিড়ে মহাদেবকে কেউ আর মানবেনা ।
নন্দী সব শুনে বললে "বাবা, আর সব ষষ্ঠীর পুজোয় তো মা-ষষ্ঠীর ওরফে মা দুর্গার পাল্লাটা একটু বেশী ভারী হয়ে যাচ্ছিল তাতে যদি তোমার নামডাকে ভাটা পড়ে তাই বুঝি এমনটি কল্লে তুমি?'
মহাবাবা বললেন " মেয়েরা তথা দেবীরা যা হুজ্জুতি শুরু করেচে তাতে দেবেরা আর পাত্তা পাবেনা বুঝলি? কোন্‌ দিন বলে বসবে "মাই চ্চয়েস!!!
নন্দী বলল, ঠিক কয়েছ বাবা। সেই দেখে ঊর্বশী-রম্ভা, ওরাও যদি বলে বসে ? "পুজো চাই! মাই চয়েস!!!"
শিব সেই শুনে বললেন, কুদোস নন্দী! এই জন্যে তোর কথায় আমি উঠি আর বসি। তোদের মা তাই বুঝি আমায় জিজ্ঞেস করছিল এতসব। মানে শিব্রাত্তির পরেই কেন আবার নীল... ইত্যাদি, ইত্যাদি।

Thursday, February 23, 2017

জগাদা যুগ যুগ জিও!


জগার কেরামতি দেখলাম ভোররাতে । তেনার রথ চলবে বলে অঘোষিত বিষ্টি এল আষাঢ়ী এক ভোরে। নিজের চলার পথ ধুয়ে শুনশান্! কি স্বার্থপর রে বাবা! তারপর আবার যে কে সেই! তুমি ঠুঁটো! তোমার দুপাশের মানুষজনেরা তো স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রপতির মত। তোমার ইচ্ছায় কর্ম তাদের । তুমি না চাইলে চলবেনা, না বললে বলবেওনা । একজন তো সোমরসে চুর! কাঁধের লাঙল কাঁধেই থাকে । কাজের বেলায় তুমি। আরেকজন তো অর্জুনের সাথে পালালো..তাও তোমার প্ররোচনায় ! বাব্বা ! পারেও বটে । হাত নেই তাতেই একাই ১০০ ! হাত থাকলে না জানি কি হত!!!

আমি জগাদার খোদ পাড়ায় গেলে সেখানে তারা ছুঁতেই দেবেনা জগাদার গা! ফেল কড়ি মাখো তেল্! তবে কড়ি ফেললে জগাদার চ্যালারা মহা খুশি । যা চাইবে তাই করতে দেবে । বললে জগাদার সাথে তোমার সিনেমার টিকিটও কেটে দেবে । ঘষ্টে ঘষ্টে জগাদা তোমাকে নিয়ে হলে পৌঁছে যাবে । গায়ে গা ঠেকিয়ে বসবে এসি হলে । মিষ্টি মিষ্টি রসালো কথা ক‌ইবে । পকেটে প্যাঁড়া, নিমকি, খাজা-গজা সব দেখিয়ে বলবে বের করে নিতে । জগাদা বেঁড়ে লোক । চোখে একটু কম দ্যাখে এই যা । বড় বড় গোল্লা গোল্লা চোখ হলে যা হয় আর কি ! দূরদৃষ্টি বেশি কিন্তু কাছের লোককে একটু কম দ্যাখে । তাই আমাদের দেখতে পায়না । otherwise ঠিকঠাক সব !
আমি বল্লুম, একটা সেলফি তুলতে দেবে আমার জগাদার সাথে? পান্ডাটা বল্ল, তর মনে? সেলফোন নিয়ে জগোন্নাথো মন্দিরে ঢোকা বারণ অছি। আমি বল্লুম, আমাকে গেটেতো আটকালোনা। পান্ডা তখন বল্ল, কিছু কড়ি ছাড়ো, মু এলাউ করি দিব। জগাদার সাথে তোমার সেলফি আমি‌ই তুলে দিব। অগত্যা একটা চকচকে পাতি বের করে তার হাতে দিলুম। তারপর তিনজনের পাশে দাঁড়িয়ে যেই ছবিখানা তুলে দিতে বলেচি তখন ব্যাটা বলে , উঁহু! শুধু জগোন্নাথেরো সঙ্গে ফটোর কথা ছিল, বাকীরা ছবিতে এলে আরো পৈসা লাগবে। আমি বল্লুম, থাক আমার সেলফি লাগবেনা, আমাকে টাকাটা ফেরত দাও তবে। সে তখন আমার মাথায় একটা চটাস করে লাঠিপেটা করে বলল, মু আর তুমারে ছাড়িচিনা। তুমি বেশ শহুরে যুবতী, দেখিব ছাতি। আমি বল্লুম, এ তো পুরো মন্দিরের মধ্যে মানহানি! জগাদাকে প্রাণপণে ডাকতে লাগলুম। বাঁচাও জগাদা! তোমার কাছে এসে শেষ অবধি এসব কি! বল্লুম, ঠিক আছে পয়সা ফেরত চাইনা আমি, একটা গান শোনাবে? সেই ধড়িবাজ পান্ডা তখন পান খাওয়া রাঙা ঠোঁটে গাইতে শুরু করলঃ

কঁড় কঁড় কৌচি, বাঁশুরী বাজাউচি, বামেতে বসিগিড়ি রসমতী রাই, ঠাকুর দরশন মিলিবেনা কাঁই!

আমি মানে মানে কেটে পড়লুম সে যাত্রায় । গর্ভগৃহের বাইরে পা দিয়েচি অমনি সে পেছন থেকে এসে আমার মাথায় আবার লাঠিপেটা করে বলল,
ধাঁই কিড়িকিড়ি, পটাকা তিলা, নিতাই গো মোর তিহিলা মিঠা
সেই তো অসিতো, বলিকা সুন্দরী, মদনমোহন পিঞ্জরিতে পাখী পুষিতো...

আমি ছুট্টে মন্দিরের বাইরে বেরিয়ে বাঁচি আর কি!

রথের দিন সকাল সকাল উঠে সাজতে গুজতে দোল ফুরোয় জগাদা এন্ড কোম্পানির। প্রতিবছর ঐদিনে জগাদার সহজসঙ্গিনী মা বিমলা ভৈরবীর বড্ড গোঁসা হয়। রথে চড়তে না পারায় বিমলার খুব আক্ষেপ । উগরে দেন ঝাঁঝ..
"সংসার, বিশ্ব ব্রহ্মান্ড রসাতলে গেল । আর তিনি কিনা ভাইবোনকে বগলে করে বেড়াতে চললেন্! আদিখ্যেতা যত্তসব্! আর আমি একলাটি র‌ইনু পড়ে ঘরের কোণে । মিন্‌সে, মাসীর বাড়ি যাবার আর সময় পেলনা? শেষ একমাস সেই চানযাত্রার দিন থেকে দরজা বন্ধ করে বসে আছেন বাবুরা সব্! মুখ দেখাদেখি বন্ধ দুনিয়ার সাথে । কি না জ্বর এয়েচে ওনার । জ্বর যেন কারো হয়না । ভালো ভালো সব খাবার খাব অথচ একটা প্যারাসিটামল বড়ি গিলবনা ! কিনা ওষুধ খেতে বমি পায় । বোঝো ঠ্যালা । আসলে কাজে ফাঁকি দিয়ে দরজা বন্ধ করে একমাস ধরে এই প্যাকেজ ট্যুরের প্ল্যান করে তিনটিতে মিলে । ধড়িবাজ ননদ আমার । উনি নাকি সুভদ্রা । আদৌ ভদ্রতা জানে কি ? নয়ত প্রতিবার যাবার আগে আমাকে একটিবারও বলে না যে বৌদি এবারটা চলো আমাদের সাথে ।
আর তেমনি চালাক ভাসুরটাও । ভালো ভালো রান্না খেতে ইচ্ছে হলে বৌদি । আঙুরের রস করে দেবার বেলায় বৌদি । কাট্‌গ্লাসের সুরাপাত্র কিনে আনার বেলায় বৌদি । ফ্রিজে বরফ বসানোর বেলায় বৌদি । আর সেই বৌদিটাকে এখন মনে পড়েনা !
আসলে পালের গোদা তো ঐ ঠুঁটো মিন্‌সেটা । তার কত্ত বায়না সামলাই এই আমি ঘেটো মড়া মেয়েছেলেটা । একশো আট রকমের হালুয়া, বত্রিশ রকমের মুচমুচে নিমকি , ছাপ্পান্ন রকমের পদ । সব ঠিকমত হচ্ছে কি না সব তদারকি করি সারাটি বছর ধরে ।
আর আমার বেলায় আমড়ার আঁটিও জোটে না একটা । পরের বছর থেকে আমার রথ চাই এই বলে দিলুম মিনসে! নয়ত দেখব কে তোমাকে রথে চড়ায়! আর মাসীটাও হয়েছে তেমন যত তেল দেয় এই বোনঝি-বোনপো তিনটেকে । সারাবছর তো এরা মাসীকে ঝিঙের বাড়ি মারলেনা তবুও বোকা মাসীটা এলাহি আয়োজন করবে এদের জন্যে সাতদিন ধরে "

বুঝতাম তুমি তেমন একটা কেউকেটা তাহলে তো তোমার নিদেন ফেসবুকে একটা একাউন্ট থাকত! আমরা সেখানেই জয় জগন্নাথস্বামী নয়নপথগামী বলে চিত্কার করে মরতাম ! তাহলে বিমলিপিসিও অত রেগে যেতনা ! না আছে ফেসবুকে তোমার একটা সেলিব্রিটি পেজ, না আছে নিজস্ব প্রোফাইল ।সারাদিন নিজের স্নান্, ভৃঙ্গার্, শৃঙ্গার আর একশো আট রকমের মন্ডা মিঠাই, বত্রিশ রকমের ভাজাভুজি আর ছাপ্পান্ন ব্যঞ্জন খেতেই ব্যস্ত! দুনিয়াটা দ্যাখো জগাদা! কত দিন বলেছি তোমায়! Go digital these days! নয়ত এতদিনের ব্র্যান্ডের ব্যান্ড বাজানোই বৃথা !

বিশ্বাস করো জগাদা! তুমি বড় না শিব বড় তা আমার মত পাপীর অজানা কিন্তু শিবরাত্রির দিনে ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দিরে শিবলিঙ্গে জল ঢালার অধিকার নেই আমার। বললুম, আমি বামুন-কন্যা, আমি বাড়িতেও শিবপুজো করি। গোদা একটা মহাপুরুত আমাকে তার ইয়া মোটা পেল্লায় বাহুমূলের খোঁচা আর কনুইয়ের এক ঠোনা মেরে বললে, "ত কি? এ লিঙ্গ অমার অচি" আমি বললুম, সে তো জানি। কিন্তু শিবলিঙ্গ তো আমাদের সকলের। পুরীতে গিয়ে সেই এক অবস্থা। শঙ্করাচার্য মন্দিরেও আমি অছ্যুত ভক্ত। অগত্যা সমুদ্দুরের বালিয়াড়িতে বসে মনের দুঃখে শিবলিঙ্ঙ গড়ে জল ঢেলে শিবরাত্রি ব্রত করলুম। তোমার অত বড় বড় চোখ হলে কি হবে ! তোমার রাজ্যে তুমি সত্যি ঠুঁটো। পান্ডাসর্বস্ব তোমার এক্তিয়ার তোমার শুধু দেখনদারি। আজ চন্দনযাত্রা, কাল স্নানযাত্রা, পরশু রথযাত্রা!

Thursday, November 17, 2016

স্বর্গীয় রমণীয় - ১৩ "রাস, c/o ভাগবত"



"তোমরা আমাকে ভালোবাসা দাও, আমি তোমাদের ভালোবাসা দিব" কানুদা এমনটি বলতেন। আমজনতাকে অবিশ্যি নয়। গোপিনীদের। গোপবালারা এক সে বড় কর এক সুন্দরী, অদ্বিতীয়া প্রেমিকা আর সারাক্ষণ কৃষ্ণপ্রেমে হাবুডুবু খাওয়া বৃন্দাবনের কিছু রমণী। এই বৃন্দাবনের গোপবালারা ভক্তিযোগে কানুকে পাবার জন্য আমরণ চেষ্টা করে গেছেন। রাধার সাথে কানুর পিরীতি তাদের বুকে শেল হয়ে বাজত। রাধা একাই কেন পাবে কানুকে? তাদের যুগলে দেখতে পেলে ঝলসে যেত গোপিনীদের চোখ, ফেটে যেত বুক। এহেন কূটনৈতিক কানু যাদবের চিন্তা হল। এত কষ্টের তৈরী ব্র্যান্ড। যুগে যুগে সেই ব্র্যান্ডকে বাজিয়েই চলেছে আম আদমী। কিন্তু বৃন্দাবনের গোপিনীরা কানুর পিরীতি থেকে বঞ্চিত থেকে যদি সেই আদি অনন্ত দুধ সাদা ব্র্যান্ডে কালি ছিটিয়ে দেয়? অগত্যা মধুসূদন। কানু যাদব ফন্দী আঁটলেন। শারদীয়া উত্সবের পরপর আম আদমীর মনখারাপ থাকে।গোপিনীদেরো ঘরের কাজকর্মে একটু ঢিলাঢালা ভাব থাকে। উত্সবের হ্যাঙ ওভার কাটতে না কাটতেই কার্তিকের পূর্ণিমায় আয়োজন করবেন রাস উত্সব... এই ছিল প্ল্যান। তিনিই স্বয়ং ইভেন্ট ম্যানেজার। c/o ভাগবত !

অতএব সতীলক্ষ্মী সব গোপিনীদের সঙ্গে কানুদার একান্তে গেট টুগেদার হল রাসলীলা। আর তাই তো কানুদা হলেন রাসবিহারী। এ হল দ্বাপরের বেত্তান্ত। তারপর কলিতেও সেই ট্র্যাডিশন অব্যাহত। বৃন্দাবনের আনাচেকানাচে কানুগত প্রাণ গোপিনীদের হৃদয়যন্ত্রে সেদিন বেজে উঠেছিল ভালোবাসার সেই সুর যা এখনো হৃদয়ঙ্গম করছেন সারা দেশের মানুষ। অতএব কানুদার রাধার সাথে পরকীয়ায় নিজের দাপুটে ব্র্যান্ডে কেউ কালি ছেটাতে পারেনি।

ঠিক যে মূহুর্তে গোপিনীরা "নাহ্‌, ঐ বাঁশী শুনে আর কাজ নাই" ভাবল তখনি কানুদা রাসলীলার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করলেন। মানে একপ্রকার গোপিনীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেই বসলেন বিচক্ষণ কানুদা। আগে বাজাতেন ভৈরবী, ইমন, শুদ্ধ বিলাবল, ভূপালী এইসব রাগ-রাগিনী। এখন বাজালেন আহির ভৈরব, পুরিয়া ধ্যানেশ্রী, আশাবরী ...যত করুণ রসে সিঞ্চিত সুরের ঝর্ণা তত‌ই পাগলপ্রায় গোপিনীদের অবস্থা। অভিসারের কথা না জানিয়েই ছুটে যেতে ইচ্ছে হল প্রাণ। সবকিছু দিতে ইচ্ছে হল কানু-দয়িতের জন্যে।

কেউ তখন দুধ দুইছিল, কেউ দুধ জ্বাল দিচ্ছিল, কেউ রাঁধছিল খিচুড়ি। কেউ নিজের সন্তানকে দুধ খাওয়াতে ব্যস্ত ছিল। কেউ স্বামীকে দফতরে পাঠানোর জন্য দেখভাল করছিল। যে যেমন অবস্থায় ছিল ঠিক তেমন অবস্থায় সবকিছু ফেলে রেখে ছুটল সেই বাঁশীর পিছুপিছু।

"কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো, আকুল করিল মন-প্রাণ"

একজন গোপিনী স্নানের পর চন্দন দিয়ে অঙ্গরাগ করতে ব্যস্ত ছিল। একজন পরছিল কাজল। একজন সবেমাত্র কাঁচুলি পরেছে, ভুলে গেল উত্তরীয় পরিধানের কথা। একজন আবার এক কানে কুন্ডল পরেই দৌড়ল। "উথালিপাথালি ওদের বুক, মনেতে নাই সুখ রে, আমায় ডুবাইলি রে, আমায় ভাসাইলি রে"

লাজলজ্জা বিসর্জন দিয়ে কানুর কুঞ্জবন রূপ বৈঠকখানায় ছুটল তারা।

চুলোয় যাক্‌ সংসার! রসাতলে যাক স্বামী-পুত্র! "রইতে নারে, বাঁশীতে ডেকেছে যারে"

বাঁশীওয়ালার ডাকে সাড়া দিয়েও বিপদ হল গোপিনীদের। কানু বাঁশীওয়ালা পরীক্ষা নেন সতত‌ই। গোপিনীরা পূর্ণিমার রজতশুভ্র জ্যোত্স্নায় বৃন্দাবনের কুঞ্জে এসেছে সব ছেড়েছুড়ে। এর মধ্যে কে কানুকে সত্যি ভালোবাসে আর কে লোক দেখানো সেটা যাচাই করতে তিনি বললেন, ভয়ঙ্কর রাতে, বনে বাদাড়ে হিংস্র বন্যপ্রাণী আছে। অতএব তোমরা ঘরে ফিরে যাও। গোপিনীরা বলল, চাঁদের আলোয় আঁধার তো দিন হয়েছে আর বৃন্দাবনের জন্তু জানোয়ার বন্ধুপূর্ণ অতএব আমরা আজ ফিরবনা এরাতে। কানুদা আবারো বললেন, তোমাদের পরিবারের লোকেরা কি বলবে? তাদের অহেতুক চিন্তা বাড়িওনা। কিন্তু গোপিনীরা নারাজ। "রহিল মোর ও ঘর দুয়ার".... কেষ্টারে লয়েই থাকবেন তেনারা।

নিজেদের মধ্যে তারা বলাবলি করতে লাগল" আজ সব ছেড়ে চলে এলাম তার জন্যে, আর এখন কিনা তিনি বলছেন ফিরে যেতে?" এদিকে প্রেমের অনুঘটক রূপে কাজ করল কার্তিকের মৃদুমন্দ হিমেল বাতাস, আকাশে রূপোর থালার মত পূর্ণচন্দ্র, আর ভেসে এল নানা ফুলের গন্ধ।

দিশেহারা হয়ে গেল সতীলক্ষ্মী গোপিনীরা। তন্ময় হয়ে গেল কানুচিন্তায়। ভুলে গেল দেহ-গেহ। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে তারা একদৃষ্টে চেয়ে কেমন যেন সম্মোহিত হয়ে গেল একে একে। কানুর রূপ, বাঁশীর সুর, প্রেমের অনুকূল প্রকৃতি সবকিছু মিলেমিশে একাকার তখন। তাদের পরপুরুষের হাবভাব, চালচলন, চটূল হাসি, অকপট অনুরাগ, মধুর বাক্যালাপ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগে ব্যস্ত তারা।

"ভিতর বাহিরে, অন্তর-অন্তরে আছো তুমি, হৃদয় জুড়ে"

তারা যারপরনাই হারিয়ে ফেলল নিজ নিজ পৃথক সত্ত্বা। প্রগাঢ় প্রেমে বুঝি এমনটিই হয়ে থাকে। পাগলপ্রায় গোপিনীরা উচ্চৈস্বরে গাইতে লাগল গান... "হরিনাম লিখে দিও অঙ্গে"



 কানুর দুষ্টুমি শুরু হল তখন। অশোক, নাগকেশর, চাঁপা গাছের আড়ালে চলে গিয়ে পরখ করতে লাগলেন তাদের প্রেমের আকুতি। লুকোচুরি চলল কিছুক্ষণ। কানুর প্রিয় ছোট ছোট ফুলগাছ, কুর্চি, মালতী, জাতি। এদের কাছে গিয়ে গোপিনীরা জিগেস করল তারা... কানুকে দেখেছ ?

এভাবে চলল কিছুক্ষণ। অবশেষে বৃন্দাবনের তরুলতার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে তারা লক্ষ্য করল কানুর খালিপায়ের ছাপ। ওরা ভাবল আবারো বুঝি কানু সেই রাধার সাথে দেখা করতে চলে গেছে। খুব অভিমান হল তাদের। হঠাত তারা দেখল কিছুদূরেই রাধা মূর্ছিত হয়ে পড়ে আছে। তা দেখে চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হল গোপিনীদের। সখীদের সেবায় রাধার জ্ঞান ফিরল। তাকে নিয়ে গোপিনীরা চাঁদের আলোয় যতদূর পর্যন্ত যাওয়া যায় ততদূর গেল। তন্ন তন্ন করে খুঁজল কানুকে। তবু তার দেখা নাইরে। তার দেখা নাই। তারপর কানুর স্তুতি শুরু হল।

তারপর কিছুটা মান-অভিমানের পালা। যার জন্য আমাদের সব ছেড়ে চলে আসা, যার বাঁশীর শব্দে আকৃষ্ট হয়ে আমরা এই গভীর বনে চলে এলাম, যার কষ্টে আমরা এতদিন কষ্ট পেলাম, যাকে ভালোবেসে আমরা সকলের কাছে খারাপ হলাম সেই কানু কিনা আমাদের বুঝলনা? অতএব কানু একজন শঠ ব্যক্তি। তিনি মিথ্যাচার করেছেন। তিনি কপট। কানু বেচারা তখনো ইনভিজিলেটরের ভূমিকায়। পরীক্ষা তিনি নিয়েই চলেছেন।

আচমকা অতর্কিতে কানু বেরিয়ে এলেন বনের মধ্যে থেকে। গলায় বনমালা আর পরণে পীতাম্বর পট্টবস্ত্র। আকস্মিক মৃত সঞ্জীবনীর কাজ হল। গোপিনীরা প্রাণ ফিরে পেলেন যেন। এবার শুরু প্রকৃত লীলার ।

সংস্কৃত গোপী শব্দটির অর্থ হল রাখালি বালিকা যাঁরা গো-সেবা করেন। কেউ বলেন গোপিনী, কেউ আবার বলেন গোপীকা। এঁরা হলেন ভক্তিমার্গে বিচরণকারী ব্রজের রমণী। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন কৃষ্ণের একশো আটজন সখী...এঁরা হলেন বৃহত্তর বলয়ের নিবিড় সাথী... চন্দ্রাবলী এঁদের মধ্যে অন্যতম। আরো নিবিড়তর বলয়ের অষ্টসখী হলেন চম্পকলতা, চিত্রা, ইন্দুলেখা ,রঙ্গদেবী, সুদেবী, তুঙ্গবিদ্যা, ললিতা, বিশাখা.......। আর সবচেয়ে কাছের এবং অন্যতমা হলেন শ্রীরাধিকা। শ্রীকৃষ্ণচরিতামৃত অনুযায়ী সব মিলিয়ে বৃন্দাবনে তখন কৃষ্ণের সাথে ষোলোহাজার গোপিনী সঙ্গ করেছিলেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার দূত ছিলেন তাদের প্রভুর। কেউ কেউ ছিলেন পরিচারিকা বা সেবাদাসী।

শ্যামলী তার চন্দনচর্চিত বাহুদুটি দিয়ে কানুকে জড়িয়ে ধরল। চন্দ্রাবলী বিনয়ের সাথে হাতজোড় করে প্রেমের পরিচয় দিল। শৈব্যা অঞ্জলিপুটে কানুর চর্বিত পান গ্রহণ করল।পদ্মাবতী নিজের বুকের মধ্যে কানুর চরণযুগল রাখল । ললিতা অনিমেষ নয়নে কানুর শ্রীমুখ দর্শন করতে করতে বিহ্বল হয়ে পড়ল। বিশাখা কানুকে নিজের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা করে চোখ বুঁজে পরম তৃপ্তি লাভ করল। আর যে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে কানু আমার, আমি কানুর ন‌ই সেই রাধিকা অভিমানে ক্ষোভে ফেটে পড়ল। বৃন্দার কানুকে দেখে পাগলপ্রায় অবস্থা। বিদ্যুত্লতার মত দেহবল্লরী নিয়ে চম্পকলতা স্থানুবত দাঁড়িয়েই র‌ইল। কখন প্রভু কৃপা করে তার হাতটা ধরবেন একটু! একটু হবে স্পর্শসুখ। বহু প্রতিক্ষীত একটুকু ছোঁয়া লাগা স্মৃতি নিয়ে ফিরে যাবেন আবার গৃহকাজে।

অতঃপর প্রাণে খুশীর জোয়ার এল। কেঁপে কেঁপে উঠল গোপবালারা। সায় দিয়েছে কানুর মন। বিরহের অবসান হল। দেবতারা বিমানে চড়ে উপস্থৈত হলেন স্বর্গলোকে। পুষ্পবৃষ্টি হতে লাগল। দুন্দুভি বেজে উঠল। রাসমন্ডল শতশত ব্রজবালার নূপুরের সিঞ্জিনী, বলয়ের কিঙ্কিনীতে তোলপাড় হতে লাগল। এ যেন এক স্বর্গীয় লীলাখেলা। সকল গোপিনীরাই অনুভব করল যে কানু তাদের দুহাত দিয়ে কন্ঠ আলিঙ্গন করছেন। নিজের মহিমাবলে কানু তখন একই অঙ্গে বহুকৃষ্ণে লীলা করতে লাগলেন তাদের সাথে। প্রত্যেকেই খুশি তখন। সম্মোহন শক্তিতে আপ্লুত তারা। সকলের মনে হল কৃষ্ণ শুধু তার্, আর কারো নয়। নিজের নিজের কাছে প্রিয়তমকে দেখে সকলেই উদ্বেলিত তখন। ব্রজবালারা কটিবন্ধের চাদর কষে বেঁধে নিলেন। কঙ্কন-বলয়ে রোল তুলে, মল-নূপুর, বিছুয়া বাজিয়ে উদ্দাম নৃত্য করতে লাগলেন সেই একমেবাদ্বিতীয় কৃষ্ণকে ঘিরে। গাইতে লাগলেন শ্রুতিমধুর গান। কানু নিজের গলা থেকে মল্লিকাফুলের মালা ছুঁড়ে দিলেন গোপিনীদের দিকে। দীর্ঘায়ত হল সে রাত। নক্ষত্রমন্ডল রাস দেখতে দেখতে বিস্মৃত হল অস্ত যেতে।

এখন আমাদের প্রশ্ন হল শ্রীকৃষ্ণ কেন পরস্ত্রীদের সাথে এহেন পরকীয়ায় লিপ্ত হলেন? আদৌ কি এ পরকীয়া প্রেম না কি অন্যকিছু? না কি দেবতা বলে তাঁর সাতখুন মাপ? ভাগবত অনুযায়ী তিনি মায়ায় বশ করেছিলেন। নিজের সাথেই নিজে খেলা করেছেন। যে ব্যক্তি শ্রদ্ধাশীল হয়ে তাঁকে একান্ত আপনার করে পেতে চায় তাঁর সাথে তিনি এমন লীলাই করেন। গোপবালারা উপলক্ষ্য মাত্র। শ্রীধর স্বামী তো বলেইছেন

"রাসলীলায় শৃঙ্গাররস ছলনামাত্র। আসলে এই লীলা মুক্তিপ্রদায়িনী।" আর তাই তো তিনি এখনো বৃন্দাবন তথা সমগ্র বিশ্বের একমেবাদ্বিতীয় ব্র্যান্ড এম্বাস্যাডার!!!

Tuesday, November 1, 2016

রমণীয় ভাইফোঁটা

স্বর্গীয় রমণীয় (৪)
ভাইফোঁটা

কার্তিকের শুক্লা প্রতিপদ কিম্বা দ্বিতীয়া । নরকাসুর বধ করে কেষ্টাদা সবেমাত্র ফিরেছেন ঘরে। বোন সুভদ্রা দাদার মুড বুঝে নিল চটপট। আগের দিন দেওয়ালির রান্নাঘর থেকে ঘিয়ের গন্ধ তখনো পুরোপুরি যায়নি চলে। রান্নাঘরে গিয়ে দুখানা মুচমুচে নিমকি, গোটাকতক ম্যাওয়া কুচোনো লাড্ডু, সোহন পাপড়ি আর এক ভাঁড় রাবড়ি এনে দাদার মুখের সামনে ধরল। কেষ্টদা তো মহা খুশি। একে মিশন সাকসেসফুল...দুষ্কৃতের বিনাশ করে সাধুদের পরিত্রাণ করতে চলেছেন বলে মহা ফূর্তি মনে আর দুই দেওয়ালির সুহাগ রাতে অগণিত গার্লফ্রেন্ডকে সাথে নিয়ে ছাদে গিয়ে কখন ফষ্টিনষ্টি করবেন সেই অহ্লাদে ভরপুর তাঁর মেজাজ। বিদ্যুতলতারা সকলে শৃঙ্গারে ব্যস্ত তখন। কেউ কেতকী-কুর্চি-কদম্ব প্রলম্বিত জলে স্পা নিচ্ছেন। কেউ আবার কর্পূর-কেওড়া-অগরুর জলে গাত্রমার্জনা করে সুগন্ধা হচ্ছেন। কেউ ধূপের ধুনোয় কেশ শুষ্ক করে ফুলের মালা জড়াতে ব্যস্ত।


কেষ্টদার দুই গৃহিণী সত্যভামা আর রুক্মিনী বৌদির মেজাজ একটু ক্ষেপে আছে আজ। একে বহুদিনের অদর্শণে প্রাণের ভেতরটা আঁকুপাঁকু অন্যথায় আসামাত্র‌ই ননদিনী সুভদ্রা কেষ্টদাকে চিলের মত ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে গেল তাদের কাছ থেকে। তারপর যদিও ননদিনী ছাড়বে তাদের কর্তামশায় তো এবার যাবেন ছাদের ওপর কিম্বা নদীর তীরে। একে কার্তিকের আকাশে রাসপূর্ণিমার হাওয়া ব‌ইল বলে !

সুভদ্রা বলল, দাদা মনে আছে কালকের কথা? এবারে কিন্তু আরো বড় উপহার চাই। ঐ ময়ূরের পালক, কদমফুলের আর্মলেট আর জাঁতিফুলের মুকুটে কিন্তু চলবেনা বলে দিলাম। এবার ডাবল ধামাকা কিন্তু। একে ভাই ফোঁটা তায় নরকাসুর বধ হয়েছে। অতএব ট্রিট চাই বস!

কেষ্টাদা মুখটা বেঁকিয়ে বললেন, তা আমাকেই বা কেন বধ করা বারেবারে? আরো একজন দাদাও তো আছে নাকি। সুভদ্রা বলল, তুমি তো গেছ নরকাসুর নিধন করতে। বলরাম দাদা? তিনি তো দ্রাক্ষারসে অবগাহন করে পড়ে রয়েছেন সেই ধনতেরস থেকে।


কেষ্টাদা প্রমাদ গনলেন। চটপট স্মার্টফোনে দেখে নিলেন ব্যাংকে কিছু পড়ে আছে কিনা। সুভদ্রাকে বললেন, ঠিক হ্যায় তব। মানাও ভাই দুজ, ঘটা করে ভাইফোঁটা হোউক! !!!


রুক্মিনী, সত্যভামা বৌদিদ্বয় শশব্যস্ত হয়ে গাত্রোত্থান করে বাজারের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন।হাজার হৌক রান্নাবাটিতো তাদেরি করতে হবেক। আরতো সকলে সুখের পায়রা! যদি আবার নন্দাই বাবু অর্জুন এসে পড়েন তাহলে আর কথাই নেই! জামাই বলে কথা! বৌদিরা আবার নন্দাইকেও ভাইফোঁটা দেয়।j

Saturday, August 20, 2016

আবার সে এসেছে ফিরিয়া

চাদ্দিকে যা রম্যের ঘটা, তাই কলম ধরতে ভয় যদি না হাসে পাঠক আমার ? তবুও লিখতে হয়। এই ধরুন মাগ্যির ম্যাগি নিয়ে যা কান্ডটি হল! আমি কোথায় ভাবছিলাম মিডডে মিলে ম্যাগি চালু হল বলে! ম্যাগি তো হল গিয়ে বাচ্ছাদের স্টেপল ফুড এখন। ব্যস্ত গৃহিনী, চাকুরে গৃহিণী, রুগ্ন গৃহিণী, রান্নার মাসীর অনুপস্থিতিতে ল্যাজে গোবরের গৃহিণীর পরম আদরের বন্ধু হল গিয়ে ম্যাগি। স্থলে, জলে, অন্তরীক্ষ্যে, এভারেস্টের মাথা থেকে কন্যাকুমারীকার জলে যেখানে যাবে কাপ্-ও-নুডলসের খাপ কিম্বা ম্যাগির পরিচিত হলদে প্যাকেটটি পেয়ে যাবে। তা না দেখি আমার প্রিয় ম্যাগির নামে কত কেচ্ছা! মোনো সোডিয়াম গ্লুটামেট আছে তাতে, লেড আছে তাতে! আরে থাকুকনা মশাই! কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরোতে পারে! জানেননা? আজ যে রাজা কাল সে ফকির। চিরদিন, কাহারো সমান নাহি যায়! আজ যে সিবিআইয়ের ফাঁদে কাল সিবিআই যে তার ফাঁদে পড়বেনা কে বলতে পারে? এফ এম সি জির দলদাস আমরা কি বাপু অতশত বুঝি? আমাদের যেমন চালাও তেমন চলি। আমরা যন্ত্র, মিডিয়া আমাদের যন্ত্রী। মোদের যেমন নাচাও, মোরা তেমনি নাচি । ধরুণ ম্যাগিকান্ডের কোপ এবার গিয়ে সোজা পড়ল পাড়ার ফুচকার ফ্যাক্টরীতে অথবা আইসক্রিমের এঁদোগলিতে। ফুচকার জলে নাকি মশার লার্ভা থেকে শুরু করে পুকুরের জল পর্যন্ত থাকে। পুকুরের জলে শৌচকর্মের বীজাণুরা দিব্যি হেসে খেলে বেড়ায়। সস্তার আইসক্রিম নাকি ড্রেনের জলে তৈরী হয়। তাতে জলজ্যান্ত স্ট্যাফাইলোকক্কাসরা দিব্যি বেঁচেবর্তে থাকে দিনের পরদিন আর হিম-সাগরে অবগাহন করে তাদের নাকি মা-ষষ্ঠীর কৃপায় দিব্যি বংশবিস্তার চলতে থাকে। একটু গরমে এলেই ওরা ক্ষমতা দেখায়। গলায় ব্যথা, কাশির অব্যর্থ জীবাণু রূপে রোগসংসারে ওদের খুব নামডাক । ম্যাগিকান্ডে না হয় একটা মাল্টিন্যাশানাল বাঁশ খেল কিন্তু ফুচকায় হাত দিলে কিম্বা ঐ ফুটপাথী আইসক্রিমে হাত দিলে বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা। এক ঘা পড়বে ফুচকাওলার ঘাড়ে। এক ঘা পড়বে লোকাল দাদার ঘাড়ে। এক ঘা পড়বে স্থানীয় কাউন্সিলারের ঘাড়ে। আর বাদবাকী পনেরোটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ার আগেই সেখানকার যত ডাক্তারবাবুরা আছেন তাঁরাই ব্যাপারটাকে চাপা দিয়ে দেবেন। কারণ? কারণ রোগী বিনা ব্যাবসা নাই, ডাক্তারবাবুর ঘুম নাই। অতএব ফুটপাথী ফুচকা ও আইসক্রিম চলতেই থাকবে। লোকাল দাদা আর কাউন্সিলর সাহেবকে ঐ ডাক্তারবাবুরাই ম্যানেজ করে দেবেন। লোক দেখিয়ে দিনকয়েক ফুচকাওলা অন্য পাড়ায় গিয়ে দাঁড়াবে। আইসক্রিম ওয়ালা দুকুরবেলায় না বেরিয়ে সন্ধ্যের ঝুলে আইসক্রিম বিকোবে আর ড্রেনের জলে, পুকুরের জলে চুন ছড়িয়ে কাউন্সিলার সাহেব মাইক হাতে বলবেন" ব্লিচিং পাউডার ছড়িয়ে দেওয়া হল সর্বত্র অতএব আজ থেকে পত্রপাঠ মশার লার্ভা, স্ট্যাফাইলোকক্কাস অন্তর্হিত হল এই এলাকা থেকে।" কানেকানে মাইক সরিয়ে ফুচকাওলাকেও বলে দেওয়া হল, যেমন চলছে চলুক। "তোমরা আমাকে তোলা দাও, আমি তোমাদের ফুচকা বেচতে দেব"। ডাক্তারবাবু মহাখুশিতে তাঁর ছাদের ওপর গভীররাতের নৈশভোজ ডাকলেন। সে যাত্রায় ফুটপাথী ফুচকা আর আইসক্রিম রক্ষে পেল। হোয়াটসএপ থেকে ফেসবুক সর্বত্র ম্যাগি নিয়ে জোকের ছড়াছড়ি। আরে মশাই ম্যাগি তো সলমন খানের চেয়েও বড় সেলেব। ঐটুকুনি হলদে প্যাকেট আর অত্তখানি স্বাদে ভরা, সুবিধেয় ঠাসা একটা মাল! ছোট্ট ছেলেটা স্কুল থেকে এসে বলল, মা! ম্যাগি ছেলে না মেয়ে বলতো? মা আবার "মাগী"র সাথে ম্যাগির নৈকট্য বুঝে উত্তর দিলেন "মেয়ে" ছেলে বলল, "হলনা, ওতো দু'মিনিটে তৈরী হতে পারে, তাই ম্যাগি হল ছেলে, ইয়ে! মাই ফেভারিট ম্যাগি! আমার ম্যাগি চাই-ই, ব্যস! আমিও ছেলে, ম্যাগিও ছেলে" ছেলের বাবা বলল, "আর সত্যি যদি লেড থাকবে তাহলে সারাদেশের ছেলেরা আজকে সলমনের মত মাসল ফুলিয়ে নটরাজ-বন্ডেড লেড, এইচবি" আর মা সেই শুনে বলল, "তাহলে মেয়েরা অত সীসা হজম করে নিশ্চয়‌ই অপ্সরা, এক্সট্রা ডার্ক, ঠিক যেন ব্ল্যাক বিউটি কৃষ্ণকলি!” মোড়ের মাথার চায়ের দোকানে ম্যাগি বিতর্কে সামিল হলেন ভোলাদা আর শিবুদা। ভোলাদা বললেন, "যাই বল আর তাই বলো ম্যাগি একদম বন থেকে বেরোল টিয়ে, সোনার টোপর মাথায় দিয়ে। ভিনিভিডিভিসি করে আজ নুডলস দুনিয়ায় তার মত পপুলার কেউ নেই। আমার মনে হচ্ছে ঐ এম-এন-সি মানে, যারা ম্যাগি তৈরী করে তাদের সাথে ডাক্তারবাবুদের ষড় আছে। নতুন নতুন রোগের সন্ধানে ব্যস্ত থাকেন তারা। হাঁচি-কাশির যুগ শেষ হয়ে ডিপথিরিয়া-টিবির যুগ ফুরোল। এডস-হেপাটাইটিস নিয়েও মানুষ যথেষ্ট সচেতন এখন। তাই নতুন কিছু ভাবনা নিয়ে হাজির হতে হবে । মিলেনিয়ামের পনেরো বছর নতুন কিছুই এগোয়নি আর। কেবল "তারে জমিন পর", "পা", "মাই নেম ইজ খান" অথবা "ফিফটিন পার্ক এভিনিউ" ছাড়া ! অতএব চলো, কুছ করকে দেখানা হ্যায়। জাপানের মিনামাতা উপসাগরে বিষ পড়ায় মাছেদের মৃত্যু ও তা থেকে মানুষের মৃত্যু হয়ে গেল গেল রব উঠেছিল। সেখানেও সীসা ছিল মধ্যমণি অতএব চলো লেড পয়জনিং নিয়ে মাতামাতি কাম আন্দোলন করি আমরা। প্রথমে আমরা ক্ষেপিয়ে বেড়াই ম্যাগি নিয়ে । তারপর ঝড় থেমে গেলে আবালবৃদ্ধবনিতাকে পুছতাছ করে তার লেড পয়জনিং আদৌ হল কিনা দেখি কিছু টেষ্ট করে। তারপর বাজারে এই রোগ নিয়ে কিছুদিন উত্তেজনা চলবে। মিডিয়া বলবে। মানুষ ভয় পাবে। তারপর চারদিকে পাড়ায় পাড়ায় লেড পয়জনিং এক্সপার্ট ডাক্তারবাবুর ক্লিনিক চালু হবে। যেমন হযেচে "ইনফার্টিলিটি এক্সপার্ট', "ওবেসিটি এক্সপার্ট", "এনোরেক্সিয়া এক্সপার্ট" ..তেমনি আরকি!লেড পয়জনিং বা যার গালভরা নাম "প্লাম্বিজম" অথবা আরো বড়সড় নাম "কলিকা পিক্টোরিয়াম" বাবুদের চেম্বারে দেখলে রোগীরাও সচেতন হবে। হাজারো গন্ডা টেষ্টক্লিনিকে নতুন টেষ্ট হবে। নতুন রোগ মানেই নতুন জনকারী। নতুন জনকারী মানেই শোরগোল। অতএব সে যাত্রায় মনে হচ্ছে ম্যাগি পার পেয়ে যাবে। তাই ম্যাগির ভাগ্য নির্ধারণ করবেন মাননীয় ডাক্তারবাবুরা। একটু আধটু লেডও থাকুক। আজিনামোটোর ছোঁয়াও থাকুক। বেঁচে যাক এমএনসি। বেঁচে থাক ম্যাগি। বেঁচে যাক ছেলেবুড়ো ! সার্জেনরা কিন্তু মুষড়ে পড়েছে বড়। ম্যাগি না খেলে বেরিয়াট্রিক সার্জারী বন্ধ হয়ে যাবে। দিব্যি ম্যাগির ফ্যাট হজম করে বাচ্চাগুলোর ওবেসিটি হচ্ছিল, সার্জেনরা বছরে অন্ততঃ দুটো হলেও কেস পাচ্ছিল।" শিবুদা বললেন, "এবার থামবেন ভোলাদা? আমাকে কিছু বলতে দেবেন্?” "দুটো ব্যাপার আছে আমার মনে হয়। সরকার বলচেন, দেশে যে হারে আলুচাষী, গমচাষীরা আত্মহত্যা করছে তার অন্যতম কারণ হল গম, আলু এসব বিক্রি পড়ে যাওয়া। মানুষ ডাল খায়না আর। ডালের দাম বেশি তাই। ভাত-রুটি-ডাল খাওয়া কমে যাচ্ছে তাই সরকারের হঠাত মনে হয়েচে ম্যাগি হল যত নষ্টের গোড়া। মানুষ ম্যাগি বেশি খাচ্ছে তাই ম্যাগির ব্যবসা লাটে ওঠাও। আর সরকারী কোঁদল চাপা দিতে কি ওষুধ লাগে জানেন তো ভোলাদা? শুধু ঠিক জায়গাটায় ঐ কোম্পানী তার দেয় অঙ্কটা মিটিয়ে দিন, এই আমার ঐকান্তিক ইচ্ছা।" কলেজের এক প্রোফেসরের নামটাই দিয়ে দিলাম "ম্যাগি" কারণ ওনার মুদ্রা দোষ। ওনার বোরিং লেকচারে ব্যতিবস্ত হয়ে আমরা "আর কতক্ষণ" ম্যাম জিগেস করলেই উনি শুধাতেন "টু মিনিটস" ! আমরা ওনার নাম বদলে দিয়ে রাখলাম "ম্যাগি" সেই ব্র্যান্ড আজ বিপর্যস্ত। সেই সুখ আজ অসুখে পরিণত। সেই হলুদ প্যাকেট আজ বিতাড়িত। সলমন খান অত বড় দোষ করে পার পেয়ে গেল আর ম্যাগির নামে যত্ত দোষ! আরে মশাই জ্বরে গা পুড়ে যাওয়া বাচ্চার ম্যাগি খেয়ে অসুখ বেড়ে গেছে বলে তো শুনিনি কখনো। একশো গ্রাম ম্যাগি আধখানা পেঁযাজ আর একটা ডিম দিয়ে দিব্যি কমপ্লিট মিল! আর কুকিং টাইম দুমিনিট। নো হ্যাপা অফ গেটিং গ্যাস আর পেটও ভরবে জেনো, ব্যাস! অতএব বস্তিতেও স্বস্তি। হাইরাইজেও মস্তি। ম্যাগি হল ফুড দুনিয়ায় সেলিব্রিটি। আজ ম্যাগির মধ্যে এমএসজি তাই এত হুজ্জুতি তোমরা করো! তোমরা যে সব বুড়ো খোকা আর কারো দোষ দেখতে নারো! কত লোক কথা দিয়ে কথা রাখেনি তার বেলা? কত ব্ল্যাক মানির হদিশ পাওনা তার বেলা? কত করাপশান "দেবা: ন জানন্তি কুতো মনুষ্যা:”, তার বেলা? কত মামলা সুবিচার পায়না তার বেলা? কত টুপি প্রতিনিয়তঃ আমাদের পরতে হয়, অন্যতম সমাজবন্ধু ডাক্তারবাবুর দ্বারা। তার বেলা? অতএব বন্ধু গুজবে কান দিবেননা। দিন আগত ঐ ! ম্যাগি বেঁচে থাকিবে। তার জনক মিষ্টার নেসলে অত বোকা নন। তিনি জানেন এ দেশে কিভাবে ব্যাওসা পাতি করতে হয়। টু আর ইজ হিউম্যান। একটু সময় দিন কেবল। তাঁর অপত্যকে রক্ষা তিনি‌ই করিবেন, বলাই বাহুল্য।

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ১৪ই আগস্ট ২০১৬