Sunday, December 13, 2015

স্বর্গীয় রমণীয় (৫)



গঙ্গা ছিল সেক্সবম্ব । সগ্গের সব দেবতারা হেডটারনার এই মেয়ের প্রেমে এক্কেরে ফিদা। সক্কলেই সে সময় ছুটেছিল গঙ্গাকে পাবার আশায়, একটু যদি তাকে ছুঁতে পারে অথবা একটু ফস্টিনষ্টি করতে পারে। মানে বেশী কিছু নয় দেবতারা নিজেদের দেবীদের ফাঁকি দিয়ে এক্সট্রা ভার্জিন মেয়ের সাথে পরকীয়া...এই আর কি। কিন্তু গঙ্গা নাছোড় কন্যে। সেক্সি হলেই কি সস্তা নাকি? অতএব মুখ বেঁকিয়ে সে চলে যেত কম্বুকন্ঠীর মত গ্রীবা হেলিয়ে। সগ্গে বসে বসে এট্টু মেয়েবাজি না করে সারাদিন যুদ্ধ আর অসুর ঠ্যাঙাতে কি ভাল্লাগে? তাই সুন্দরী মেয়ে দেখলেই ছোঁকছোঁকানি। ঐ মানে একটু ডাইভারশান। আর কিছুতো নেই সে মুলুকে। ইনটারনেট, কেবল, সেলফোন, ল্যাপটপ, এফ এম রেডিও। বরফের রাজ্যে সারাদিন যেন সফেদ সমাধিতে বসে থাকা আর গোঁফে তা দেওয়া, দাড়ি চুলকোনো আর জটার উকুনবাছা । এদিকে তেমনি এক সগ্গরাজ্যে বড় হচ্ছিল গঙ্গা। যেমন তার রূপ তেমনি তার চলন। যেমন তার লাবণ্য তেমনি সে গম্ভীর। ভাঙে তবু মচকায়না।
তুখোড় সব দেবতারা নাকানিচোবানি। তারে ধরি ধরি মনে করি, ধরতে গিয়ে আর পেলেম না টাইপ অবস্থা সকলের। এদিকে অযোধ্যার রাজা সগর তখন ভাবছেন অশ্বমেধ যজ্ঞটজ্ঞ করে সগ্গের দেবরাজ হবেন।
প্রথামত একটি অশ্বকে মন্ত্রপূত করে ইচ্ছাভ্রমণে ছেড়ে দিলেন । সে বচ্ছরান্তে ঘুরে ফিরলে অনুষ্ঠান, যাগযজ্ঞ ইত্যাদি হবে। সগর তাঁর ষাটহাজার পুত্রকে নিয়োগ করলেন অশ্বটির রক্ষকরূপে।
এদিকে দেবরাজ ইন্দ্রের মহাচিন্তা হল। তিনি ভাবলেন যদি এই অশ্বমেধ যজ্ঞের সফলতার কারণে সগরের মনস্কামনা পূর্ণ হয় তবে উনি স্বর্গ্যরাজ্য হারাতেও পারেন । তাই রাতারাতি অশ্বটিকে সবার অলখ্যে পাতালে সরিয়ে দিয়ে ঘোড়াচোরের আখ্যা পেলেন । পাতাল প্রদেশে সমুদ্রতটে আশ্রমে ধ্যানমগ্ন কপিলমুণির কাছাকাছি অশ্বটিকে বেঁধে রাখলেন ইন্দ্র।
সেযুগে স্বর্গ বলা হত উত্তরের উচ্চতর হিমালয়কে। মর্ত্য হল সমগ্র সমতট ভূমি আর্যাবর্ত আর পাতাল হল সমগ্র দক্ষিণের নিম্নভূমি । জল-জঙ্গলে পরিপূর্ণ, শ্বাপদসঙ্কুল, খাল-ডোবা-নালা আর সাপখোপের আখড়া এই দুর্গম পাতালরাজ্যটি ছিল সাধারণের অগম্য স্থান। স্বর্গ, মর্ত্যের সর্বত্র অশ্বটিকে খুঁজে না পেয়ে সগররাজার ষাটহাজার পুত্র পাতালে অনুসন্ধান কার্য চালাল। এক মুণির কুটিরের সমুখে অশ্বটিকে বাঁধা দেখতে পেয়ে তারা ভাবল এই মুণি‌ই বুঝি অশ্বচোর। তাদের প্রশ্নে, কোলাহলে ধ্যানম্গ্ন কপিলমুণি ক্রোধের বশে সগরের ষাটহাজার পুত্র ভস্মীভূত হল ।
এবার যজ্ঞের ঘোড়া ফিরে না আসায় সগরের খোঁজ শুরু। ভাইয়ের পুত্র অংশুমানকে পাঠালেন সন্ধান করতে। অংশুমান ঘুরতে ঘুরতে কপিলের আশ্রমে দেখলেন যজ্ঞের ঘোড়াটিকে। কপিল জানালেন অংশুমানের ষাটহাজার পিতৃব্যের ভস্মীভূত হবার কথা। তাকে ঘোড়াটি ফিরিয়ে নিয়ে যাবার কথা বললেন। কিন্তু অংশুমান সেই ষাটহাজার পিতৃব্যের পারলৌকিক ক্রিয়া-তর্পণ কোথায় সারবেন? সাধারণ জলে তো তাদের মুক্তি অসম্ভব। অংশুমান ফিরে এলেন সগর রাজার কাছে। অশ্ব ফিরে আসায় সগররাজা অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পন্ন করলেন কিন্তু পুত্রগণের আত্মার কল্যাণে কোনো কাজ হলনা দেখে মনের খুঁতখুঁতুনি থেকেই গেল। স্বর্গ থেকে গঙ্গাধারাকে নামিয়ে না আনলে কি করে তাঁর পুত্রদের আত্মার মুক্তি সম্ভব? ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর ততদিনে কেউ গঙ্গা নামের ঐ সুন্দরী মেয়ের নাগাল পাওয়া তো দূরের কথা, চোখের দেখা দেখেও ফ্যান্টাসাইজ করতেও পারেনি।
কলকাঠি নাড়লেন নাটের গুরু নারায়ণ। গঙ্গা মাঈয়্যা কিছুতেই মর্ত্যে অবতরণ করবেনা ? স্বর্গসুখ ছেড়ে নীচে নামতে সে নারাজ?
ব্রহ্মার হাতে কমন্ডলু থাকত । শিবের থাকত জটা। বিষ্ণু ভাবলেন এই হবে আমার ইউএসপি। মায়ার খেলায় তিনি ওস্তাদ।
সগর রাজবংশের আরেক উত্তরসুরী কোশলরাজ ভগীরথ নারায়ণের আদেশে একহাজার বছর কঠোর তপস্যার পর ব্রহ্মাকে তুষ্ট করতে সমর্থ হন । নারায়ণ কাজে লাগালেন তাকে।
নারায়ণ গেলেন ব্রহ্মার সামনে । যেই না ব্রহ্মা হাতের কমন্ডলুর জল নারায়ণের পাদপদ্মে ঢালা অমনি নারায়ণের পা ধোয়া জল গড়িয়ে পড়ল সহস্রধারা রূপে। নারায়ণ বললেন, ভগীরথ এই হল তোমার গঙ্গাধারা। হাতের শাঁখটি ভগীরথের হাতে দিয়ে বললেন, এই হল প্রকৃষ্ট সময়। গঙ্গাকে এবার ভুলিয়ে ভালিয়ে মর্ত্যে নিয়ে চলো। তুমি শাঁখ বাজাতে বাজাতে আগে চলো আর পেছনে চলুক এই জলধারা।
উদ্ভিনযৌবনা গঙ্গার সিডাকশন মেকানিজমটা একটু ভিন্নস্বাদের। সামনে তার মধ্যবয়সী, সংসারে চেটে যাওয়া মাঝবয়সী হ্যান্ডসাম । সেও বলে আমিও খেলাব তাদের। স্বর্গের সুখ যখন ছেড়েইছি তখন তোমাদেরো কালঘাম ছোটাবো।
ভগীরথ চললেন । পেছনে রূপসী গঙ্গা । কিন্তু নাছোড় গঙ্গা একবার লুকোয় গুহার মধ্যে তো আরেকবার ঢুকে পড়ে গিরিকন্দরে । আবার খলখল করে বয়ে চলে তো আবার নানা অছিলায় হারিয়ে যায় ভগীরথের চোখের সামনে থেকে। পাহাড়ীপথ ভগীরথের শঙ্খধ্বনিতে মুখর হয়। কিন্তু সু‌উচ্চ পর্বতশৃঙ্গ থেকে কি করে সে লাফিয়ে পড়বে ? বেগবতী স্রোতস্বিনীর আছড়ে পড়া কি আর ধরিত্রী স‌ইতে পারবে? রসাতল হবে সেই চিন্তায় ব্রহ্মা ভগীরথকে শিবের শরণ নিতে বললেন। শিব মাথা পেতে দাঁড়িয়ে নিজের জটায় ধারণ করলেন গঙ্গাকে। পাহাড়ের মাথা থেকে লাফিয়ে পড়লেন গঙ্গা। শিবের জটাজাল ছিন্নভিন্ন করে স্বর্গ প্রবাহিনী গঙ্গার ধারা মর্ত্যে প্রবাহিত হল ।
এইভাবে অসংখ্য বাধা-বিপত্তি সামলিয়ে অবশেষে ভগীরথের দেখানো পথ ধরে গঙ্গা হল দক্ষিণমুখী। সবশেষে ভগীরথের শঙ্খধ্বনি অণুসরণ করতে করতে গঙ্গা গিয়ে সোজা হাজির কপিলমুনির আশ্রমের দিকে। আর বঙ্গের মধ্যে গঙ্গার এই দক্ষিণমুখী শেষ ধারাটির নাম হল ভাগিরথী । সাগরদ্বীপে গঙ্গার জলের স্পর্শে সগরমুণির ষাটহাজার পুত্রের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হলে শান্তি পেল তাদের পারলৌকিক আত্মা। উদ্ধার হয়ে স্বর্গে পাড়ি দিল তারা।
মেয়ের কাজ শেষ। লীলায়িত ছন্দে গঙ্গা ঝাঁপ দিলেন সমুদ্রে। গঙ্গার সাথে সাগরের মিলন হল আর এই স্থান বিখ্যাত হল সাগরসঙ্গম বা গঙ্গাসাগর নামে।
কিন্তু ফাইনালি ভগীরথ-ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরকে ডিচ মেরে গঙ্গা তার দয়িতের সাথে মিলিত হল। সেটাই এ গল্পের ট্র্যাজেডি।

স্বর্গীয় রমণীয় (৩)


মেয়ে যুদ্ধ করে জিতে এয়েচে, মানে দশহাতে অসুর বধ করেচে, দেশ জুড়ে সবাই মেয়েটাকে বাহবা দিতেছে.... মাদুগ্গা কৈলাসে ফিরে গেচেন অনেকদিন হল। দেবতারা বসে সেখানে গোঁফে তা দিতেছেন।
একা মেয়েছেলের কত ক্ষেমতা বাপু, কেষ্টদা অকপটে মেনে নিল।
কেউ বলছে, ধুস্‌ তবুও যদি বুঝতুম একা সামলেছে সব।
ধার করা সব অস্ত্র শস্ত্র পেলে আমারাও অমন দশটা অসুর মারতে পারতি, ইন্দর দাদাবাবুতো কোনো রাখঢাক নেই, বলেই ফেল্ল।
তবে যাই বলো বাপু দুগ্গাটা দেকিয়ে দিল! শিবুদা বৌয়ের প্রশংসায় আরো কয়েক ছিলিম বেশী গাঁজা নিয়েছে ।
এখন কৈলাসে মহিষাসুর বধের দ্বিতীয় ইনিংসের তোড়জোড়। বড়াখানার আয়োজন হচ্ছে। দুর্গার অনারে। তবে অহংকারে পা পড়তেচেনা কারো। যেন তেনারাই যুদ্ধ করে এয়েচেন। তাই দেখে শুনে শিবুদা বললেন তা তোমাদের বৌয়েরা তো সব পাটরাণী। বলি আমার বৌ অসুর মেরেচে তো তোমাদের এত গর্বের কি! এমন ভাবখানা কচ্চো যেন তোমরাই মেরেচো!
ব্রহ্মা সেই শুনে একটা ফন্দী আঁটলেন। ব্রাহ্মণের রূপ ধরে রাজসভায় এসে সকলের সামনে একটা তৃণ মানে কচি দুব্বোঘাসের টুকরো রেখে বললেন, দেখি কত্ত ক্ষেমতা বাপু তোমাদের্? এই তৃনটাকে উড়িয়ে দাওতো যেমন করেই হোক!
পবনদেব এলেন। বললেন্, এ আর এমন কি! কিন্তু শত চেষ্টা করেও পারলেন না ঐ ঘাসের টুকরোকে হটাতে। এরপর অগ্নিদেব এলেন তৃণকে পুড়িয়ে দেবার জন্যে। সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও বিফল হলেন।
তখন ব্রহ্মা স্বয়ং নিজের রূপ ধরে বল্লেন, কি করে পারবে তোমরা? সারাটা জগতকে যিনি ধারণ করে রয়েছেন তিনিই তো মায়া-মমতা-স্নেহ দিয়ে আগলে রেখেছেন ঐ তৃণটুকুনিকে। অতএব স্বীকার করলে তো ঐ জগদ্ধ্বাত্রীর কত্ত ক্ষেমতা? আর তোমরা কিনা দুর্গার অসুরবধ নিয়ে বুক ফোলাচ্ছ্, গোঁফে তা দিছ, পার্টির আয়োজন কচ্চো যেন তোমরাই অসুরটাকে মেরেচো!!!
অতএব এখন দুর্গা=কালী--জগদ্ধ্বাত্রীর অনারে আরো একবার পার্টি হৌক্! কেষ্টদা বলে উঠলেন!!!

Saturday, December 12, 2015

স্বর্গীয় রমণীয়(২)


স্বর্গীয় রমণীয় – কবিতা ক্লাব (রম্যরচনা-নভেম্বর-২০১৫)

-বলি হচ্ছেটা কি? আমার বৌ ফর্সা হবে না কালো হবে তা নিয়ে কার এত মাথাব্যথা! আমি যদি স্বেচ্ছায় কালোমেয়েকে ঘরে তুলি তাতে কার কি বলার আছে বাপু! কালো আর ধলো বাইরে কেবল, ভেতরে তো সব এক‌ই বাপু! বলি আমার সাথে ছিষ্টি করতে পারলেই তো কেল্লাফতে ! তা নয় সেই কালোমেয়েটা ঘরে আসা অবধি কানের কানকো নাড়িয়ে দিল ! নন্দী, এক ছিলিম কড়া করে গাঁজা সেজে আনতো !
শিবুদা বেশ ঝেঁঝে রয়েছেন। দুধেআলতা পায়ে নতুন বৌটা ঘরে ঢোকেনি তখনো তাই নিয়ে কৈলাসে কানাঘুষো চলছে । কেষ্টদা তো মুখ ফসকে বলেই ফেললেন, "হোক কলরবের" তালিম নিয়েছেন তালেবররা
ইন্দর দাদাবাবু ঠিক এই সময়েই শিবুদার মনোরঞ্জনের জন্য অপ্সরাকে তাঁর কাছে পাঠালেন! 'দিন আগে শিবুদার বলে, না জানি কি অসম্ভবকে তিনি সম্ভব করেছেন তাই ভেটস্বরূপ শিবুদাকে ঘুষ হিসেবে স্বর্গের বার-ড্যান্সার পাঠানো । যে যার কানেকশান দেখায়। শিবুদা কালীকে বিয়ে করে এনে ভাবে কতবড়ো নারীর ঘরণী তিনি। ইন্দরদাদাবাবু অপ্সরাদের পাঠিয়ে দেখাতে চান কত ক্ষেমতা তার। মাঝখান থেকে কালীর নাভিশ্বাস ওঠে ।
শিবুদার আবার ইন্দর দাদাবাবু, কেষ্টদার মত মেয়েমানুষে ছোঁকছোকানি নেই । তিনি বেশ ভয়ে ভয়ে অপ্সরাদের বললেন, দেখো, আমার ঘরে নতুন বৌ এখন। তোমরা বরং তার অতিথি হও ! এই বলে কালীকে অপ্সরাদের সামনেই আদরের সাথে ডাকলেন,
-হে অঞ্জনসদৃশ শ্যামলী, আমার রূপসী কুচকুচে কালী, ওগো বধূ ব্ল্যাক-বিউটি ! ক‌ই ? এসো একটিবার সামনে, দ্যাখো কারা এসেচেন তোমার সাথে আলাপ করতে, তোমাকে নাচগান শোনাতে!
ফর্সা অপ্সরাদের সামনে এরূপ কুরুচিকর সম্বোধনে কালী গেলেন ক্ষেপে। একে নতুন বৌ, তায় আবার রাসভারী, মেজাজী, দাপুটে এক নারী। তাঁর মোটেও সহ্য হলনা।
তিনি মনে মনে বললেন, " কি এত বড় আস্পর্ধা! আমাকে বাইরের নারীর সামনে কালো বলা! আমিও দেখিয়ে দেব আমার প্রকৃত স্বরূপ। মনের দুঃখে গঙ্গায় গিয়ে তপস্যা শুরু করলেন কালী। নিজের গায়ের কৃষ্ণকোষগুলি একে একে পরিত্যাগ করলেন। যেন খোলস ছাড়ছেন তিনি। দ্বিখণ্ডিত ব্যাক্তিত্ত্ব বা স্প্লিট পার্সোনালিটি বলে যাকে। কালো রং অনায়াসে বদলে ফেলে কালী হলেন গৌরী ।
এবার ঝাঁটারূপেণ সংস্থিতা হয়ে গৌরী অপ্সরাদের সম্মুখে এসে হাসিমুখে বললেন,
-এবার বুঝতে পারছো তোমরা? নেশাভাঙ করে, ছাইভস্ম মেখে তোমাদের শিবুদার মাথাটা এক্কেবারে খারাপ হয়ে গেছে। আমায় বলে কিনা নতুন বৌ! আমার সংসারে কত্ত কাজ আর আমি নাকি এখন নাচ-গান শুনব? তা মেয়েরা, তোমরা আজকাল বুঝি একটু বেশী খাচ্ছো। নাচের ফিগারটাতো নষ্ট করে ফেলেচো দেকচি। আমার বাবার আমল থেকে তো তোমাদের জানি । হেলেন, মিস শেফালি মার্কা ধুবলা পাতলা ছিলে সব! বলি এহেন বপু নিয়ে বালা নাচো কি করে ? তার চেয়ে আগে একটু মেদ ঝরাও, তারপর না হয় এসো কৈলাসে। আমি ফরাস বিছিয়ে, আতর ছড়িয়ে, অম্বুরী তামাক সেজে বসে থাকব তোমাদের জন্যে।
এদিকে অপ্সরাদের সামনে তো তিনি গৌরী ওদিকে আড়ালে অন্তঃপুরে আবার তিনি অভিমানে জর্জরিতা কালী । শিবুদার সেদিন কালরাত্রি। কালীর সাথে সেরাতে ভেট হবার কথা নয়। কিন্তু পান্ডববর্জিত স্বামীর ঘরে শাশুড়ি-ননদের কাঁটাও নেই। অগত্যা সেরাতেই ফর্দা ফাঁস।কিন্তু অন্তঃপুরে বৌকে খুঁজে পেলেননা শিবুদা। বিস্মিত শিবুদা নারদকে সব খুলে বললেন। নারদ একাধারে স্বর্গের গেজেট অন্যধারে রয়টার। খবর সংগ্রহ করতে তার জুড়ি নেই। অচিরেই খবর নিয়ে জানালেন শিবুদার বৌ কালী সুমেরু পর্বতের মাথায় এক দুর্গম স্থানে অভিমানে গোঁসাঘরে । নারদ তো পাঁচা করতে ওস্তাদ । তিনি সাপের গালেও চুমু খান, ব্যঙের গালেও চুমু খান। কালীর কাছে হাজির হয়ে তাঁর গোঁসার কারণ জানতে চাইলেন। কালী বললেন, শিবুদা তাঁর বিহনে কেমন আছেন? নারদ বললেন্, খাসা আছেন। কালীর জন্য তাঁর বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই। তিনি এখন পুনরায় বিয়ে করার জন্য বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন।
কালী সেই কথা শুনে রেগে আগুণ, তেলে বেগুণ হয়ে ষোড়শী মেয়ের রূপ ধরে এক ছুট্টে শিবুদার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি ভুলে গেলে তোমার প্রতিজ্ঞা? আমায় বিয়ে করে আবারো তুমি বিয়ে করতে চলেছো? সেই কথা শুনে শিবুদা তো মহা খুশি। ভাবলেন নারদকে পাঠিয়ে কাজ হল । কালীকে জড়িয়ে ধরে হামি খেতে খেতে বললেন, আমি যে কে তোমার, তুমি তা বুঝে নাও। আমি চিরদিন তোমারি তো থাকব, তুমি আমার, আমি তোমার....ব্লা, ব্লা, ব্লা । আজ থেকে তোমার এই মহাবিদ্যারূপের নাম দিলাম ভুবনেশ্বরী।

Monday, November 16, 2015

স্বর্গীয় রমণীয়(৪)


কার্তিকের শুক্লা প্রতিপদ কিম্বা দ্বিতীয়া । নরকাসুর বধ করে কেষ্টাদা সবেমাত্র ফিরেছেন ঘরে। বোন সুভদ্রা দাদার মুড বুঝে নিল চটপট। আগের দিন দেওয়ালির রান্নাঘর থেকে ঘিয়ের গন্ধ তখনো পুরোপুরি যায়নি চলে। রান্নাঘরে গিয়ে দুখানা মুচমুচে নিমকি, গোটাকতক ম্যাওয়া কুচোনো লাড্ডু, সোহন পাপড়ি আর এক ভাঁড় রাবড়ি এনে দাদার মুখের সামনে ধরল। কেষ্টদা তো মহা খুশি। একে মিশন সাকসেসফুল...দুষ্কৃতের বিনাশ করে সাধুদের পরিত্রাণ করতে চলেছেন বলে মহা ফূর্তি মনে আর দুই দেওয়ালির সুহাগ রাতে অগণিত গার্লফ্রেন্ডকে সাথে নিয়ে ছাদে গিয়ে কখন ফষ্টিনষ্টি করবেন সেই অহ্লাদে ভরপুর তাঁর মেজাজ। বিদ্যুতলতারা সকলে শৃঙ্গারে ব্যস্ত তখন। কেউ কেতকী-কুর্চি-কদম্ব প্রলম্বিত জলে স্পা নিচ্ছেন। কেউ আবার কর্পূর-কেওড়া-অগরুর জলে গাত্রমার্জনা করে সুগন্ধা হচ্ছেন। কেউ ধূপের ধুনোয় কেশ শুষ্ক করে ফুলের মালা জড়াতে ব্যস্ত।

কেষ্টদার দুই গৃহিণী সত্যভামা আর রুক্মিনী বৌদির মেজাজ একটু ক্ষেপে আছে আজ। একে বহুদিনের অদর্শণে প্রাণের ভেতরটা আঁকুপাঁকু অন্যথায় আসামাত্র‌ই ননদিনী সুভদ্রা কেষ্টদাকে চিলের মত ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে গেল তাদের কাছ থেকে। তারপর যদিও ননদিনী ছাড়বে তাদের কর্তামশায় তো এবার যাবেন ছাদের ওপর কিম্বা নদীর তীরে। একে কার্তিকের আকাশে রাসপূর্ণিমার হাওয়া ব‌ইল বলে !
সুভদ্রা বলল, দাদা মনে আছে কালকের কথা? এবারে কিন্তু আরো বড় উপহার চাই। ঐ ময়ূরের পালক, কদমফুলের আর্মলেট আর জাঁতিফুলের মুকুটে কিন্তু চলবেনা বলে দিলাম। এবার ডাবল ধামাকা কিন্তু। একে ভাই ফোঁটা তায় নরকাসুর বধ হয়েছে। অতএব ট্রিট চাই বস!
কেষ্টাদা মুখটা বেঁকিয়ে বললেন, তা আমাকেই বা কেন বধ করা বারেবারে? আরো একজন দাদাও তো আছে নাকি। সুভদ্রা বলল, তুমি তো গেছ নরকাসুর নিধন করতে। বলরাম দাদা? তিনি তো দ্রাক্ষারসে অবগাহন করে পড়ে রয়েছেন সেই ধনতেরস থেকে।

কেষ্টাদা প্রমাদ গনলেন। চটপট স্মার্টফোনে দেখে নিলেন ব্যাংকে কিছু পড়ে আছে কিনা। সুভদ্রাকে বললেন, ঠিক হ্যায় তব। মানাও ভাই দুজ, ঘটা করে ভাইফোঁটা হোউক! !!!

রুক্মিনী, সত্যভামা বৌদিদ্বয় শশব্যস্ত হয়ে গাত্রোত্থান করে বাজারের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন।হাজার হৌক রান্নাবাটিতো তাদেরি করতে হবেক। আরতো সকলে সুখের পায়রা! যদি আবার নন্দাই বাবু অর্জুন এসে পড়েন তাহলে আর কথাই নেই! জামাই বলে কথা! বৌদিরা আবার নন্দাইকেও ভাইফোঁটা দেয়।

স্বর্গীয় রমণীয়-(১) কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য...


তারকাসুরের অত্যাচারে সমগ্র দেবকুল অতিষ্ঠ। কেউ বধ করতে পারছিলনা তাকে। দরকার হল অমিত পরাক্রমশালী এক যোদ্ধার যে কিনা অনায়াসে বধ করবে তাকে এবং দেবতাদের রক্ষা করবে।
তারকাসুর নিধনের জন্য ব্রহ্মার একবার মনে হল শিব-পার্বতীর একটা ছেলে হওয়া খুব দরকার। সে হবে দেবসেনাপতি।  ব্রহ্মার আদেশ মাথায় নিয়ে শিবুদা পার্বতীকে নিয়ে মহাসুখে দরজায় খিল আঁটলেন। রতিবিহ্বলা পাব্বতী কাঁচুলি খুলছেন এলো চুলে। একে একে সব বস্ত্রের পরত সরাতে সরাতেই  শিবুদা ফিদা এক্কেরে।  জটাজুট মাথায় তুলে এবার জোরকদমে প্রস্তুতি.. চলতে লাগল সম্ভোগ পর্ব। ওদিকে হর-গৌরীর অন্তহীন ফোর-প্লে তে  রতিক্রিয়া বিলম্বিত হল। অধৈর্য হয়ে শিবুদার ইয়ারদোস্ত দেবগণ বলল, বুড়ো ভাম বেম্মাদার আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, ঘাটের মড়া শিবুটাকে এই বয়সে কিনা ঐসব কম্মো করতে পাঠায়!  তারা  মদনদেবকে প্রথমে পাঠালেন শিব-পার্বতীর মাষ্টার বেডরুমে তলব করতে। শিবুদা চরম উত্তেজনার মুহূর্তে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে মদনকে বাণ মেরে ভস্মীভূত করলেন। আবারো দরজায় খিল। এবার পাঠানো হল অগ্নিকে। শিবের অবস্থা তখন নালে-ঝোলে। পার্বতীকে ইমপ্রেগনেট করা তো দূরের কথা মৈথুনরত শিবের রেতঃ স্খলিত হল অগ্নির সম্মুখে। শিবুদার কাপড়েচোপড়ে অবস্থা দেখে,  অগ্নি মূল্যবান কেমিক্যালটুকুকে কোনোমতে  নিয়ে গঙ্গায় ফেলে এলেন। ব্যাস! একফোঁটাই অনেক।  সেখান থেকে দেবশিশুর জন্ম হল। তাই গঙ্গা হল কার্তিকের জন্মদাত্রী জননী। এবার কে দেখবে এই সদ্যোজাতকে?গঙ্গার তো অবৈধ শিশু কার্তিক। উপায়ও হল সাথে সাথে.... ছ'জন কৃত্তিকা, মানে আয়ার সমতুল্য ঐ শিশুকে স্তন্যদান করে পালন করতে লাগলেন। পার্বতী জানতে পেরে রেগে অগ্নিশর্মা।ছেলে বলে কথা!!! যেহেতু ঐ পুত্র শিবের ঔরসজাত ঐ পুত্রের মা হবেন তিনিই । তাই তো মাদুর্গা না বিইয়ে কানাইয়ের,  থুড়ি "কার্তিকের মা" হয়ে গেলেন। আর তারকাসুর বধ করে ফেমাস হয়ে গেলেন দেবসেনাপতি বা দেবলোকের আর্মির মেজর জেনারেল । টেকনিক্যালি গঙ্গার গর্ভে জন্ম তাই কার্তিকের এক নাম গাঙ্গেয়। থিওরিটিকালি কৃত্তিকারা মায়ের মত পালন করেছিল তাই আরেক নাম কার্তিকেয় ।
আর বেসিকালি মহাদেবের পুত্র তাই আরেক নাম শিবসুত ।    

Thursday, October 15, 2015

কৈলাসবাসীর কলকাতা যাত্রা


   
   
গুরুচন্ডা৯ পুজো ইস্পেশাল





কৈলাসবাসীর কলকাতা যাত্রা

(১)

মা আসেন প্রতিবছর। মা জানতেও পারেন না দেশের কী অবস্থা, দশের কী হাল। তবুও দেশ ও দশ প্রতি অণুপল শুনতে থাকে মায়ের আগমনের প্রতিধ্বনি। এবার মা আসছেন বদলের বঙ্গে। সেটাই বড়কথা। মায়েরও হাওয়াবদল হবে আশা করা যায়। কিন্তু প্রতিবছরের মত বাজারের দাম বদলায়না। রাস্তাঘাট সারাই হয়না। রাজনীতির অশুভ আঁতাত, খরা-অতিবৃষ্টির টানাপোড়েনে রোগের হ্রাস-বৃদ্ধি, প্লাসটিক না পেপার, পরীক্ষার পাশফেল, রিসেশান-ইনফ্লেশান চাপানউতোর সবকিছু চাপা পড়ে যায় কৈলাশ এন্ড কোং দের আগমনে। ওবামা-ওসামার উত্থান-পতনে, বিস্ফোরণে, দু:খের যজ্ঞে আহুতি দেয় দেশবাসী। সব জটিল প্রশ্নের টেস্টপেপারের মুখোমুখি হতে হয় কৈলাস পরিবারকে। হাতের পাঁচ, বাজারে হাজারের কান্না তো আছেই। খরস্রোতা তিস্তার জল বয়ে চলে প্রতিদিনের নিয়মে..

রথের পরেপরেই প্লেনের টিকিটটা সস্তায় কেটে নিয়েছে তার বড়ছেলে। বড়ছেলে এবার বলেছেন বঙ্গে এসে জিমে যাবেন ঐ ক'দিন। তা শুনে বড়মেয়ে বললে "ঐ ক'দিনে কী হবে রে? তোর যা অবস্থা এবার একটা ট্রেডমিল সিংহের পিঠে করে নিয়ে আয় বরং।'

ছোটমেয়ে বলে "এখন তো ওখানে সব সুগারফ্রি। তোর চিন্তা নেইরে দাদা।'

বড়মেয়ে বললে "তোর নিজের চুলগুলোর দিকে তাকা একবার। আর সময় নেই। এবার একটু যত্নটত্ন কর আর তার সাথে দেখ রাত জেগে পড়েপড়ে চোখমুখের কী অবস্থা করেছিস...'

ছোটমেয়ে বললে "মহালয়ার পরেও তো দিন সাতেক সময় থাকে রে দিদি। তখন সব হয়ে যাবে। এরোমা থেরাপি করে নেবখনে।'

শুনে মা বললে "বাপের একপয়সা রোজগারের মুরোদ নেই আর তাঁর ছেলেমেয়েরা ফূর্তি করে যা আছে তা ভাঙিয়ে খেয়ে শেষ করছে।'

বড়মেয়ে বললে "আহা মা, অমন কথা বলছ কেন? আমি তো বাবার যা ছিল সব ঠিকঠাক লগ্নি করেছি যাতে আমাদের এই সময়টায় একটু দুহাত তুলে খরচাপাতি করতে পারি।' ছোট ছেলেটা বলে উঠল "বাবা ভাঙ খান আমরা ভাঙিয়ে খাই।'

ছোটমেয়ে বললে "এই যুগে ডিজাইনার বুটিকের শাড়ি, হাবিবের হেয়ারকাট, গোল্ড ফেসিয়াল, তানিষ্কের গোল্ডেন হারভেষ্ট না করলে প্যান্ডেলে কেউ পাত্তাই দেবেনা।' মা বললে "ওখানে পাত্তা পেয়েই বা কী হবে? তোরা কি কেউ বিয়েটিয়ে করে আমাকে একটু শান্তি দিবি? স্থায়ী একটা সংসার পাতবি কখনো? আমাকে দেখ ঐ পাগলছাগল মানুষটাকে নিয়ে, ওর নেশাটেশা সব মেনে নিয়ে আজীবন কাটিয়ে দিলাম এখানে, তোদের সে ধৈর্য্য আছে? '

বড়মেয়ে বললে "দ্যাখো মা, বিয়ে করে সংসার পাতলেই কি মোক্ষলাভ হবে? স্টেটাস চাই বুঝলেনা? সোশ্যাল স্টেটাস। কৈলাসে ক্রোড়পতি হয়ে বসে থাকলে কিস্যুটি হবেনা। বেম্মা, বিষ্ণু, বাবার আওতায় থাকলেই হয়েছে। এখান থেকে পাততাড়ি গোটাতে হবে। বদলের বঙ্গে গিয়ে এবার সব দেখেশুনে আসব। অনেক হাউসিং প্রজেক্ট হচ্ছে গঙ্গার আশেপাশে। তাই তো ক'দিন আগে টিকিটটা কাটলুম আমরা। গিয়ে একটা বাড়িটাড়ি বুক করে আসব এবার। মোচ্ছব শুরু হয়ে গেলে সেখানে আর পথ চলাই দায়।'

ছোটমেয়ে বললে "ওখানে শুনেছি কোচিংক্লাসের খুব রমরমা। আমি তো কিছু না হোক গোটা দশেক ছেলে পড়িয়েই আমার হাতখরচা যোগাতে পারব।'

বড়মেয়ে বললে "আমি তো আর কিছু নাহোক ইনভেষ্টমেন্ট কনসাল্টিং করে বেশ রোজগার করতে পারব।'

বড়ছেলে বললে "আমি একটা মিষ্টির দোকানটোকান খুলে নিতে পারব। মিষ্টির বুটিক অর্থাৎ স্পেশালাইজড মিষ্টি থাকবে সেখানে। চকোলেট পান্তুয়া থেকে রাজকীয় রাতাবী, রাজকেশরভোগ থেকে আবারখাবো, সরপুরিয়া সরভাজা থেকে হৃদয়খুশ।'

ছোটছেলে বললে "হ্যঁ¡, শর্করাতেই তোমার ভাগ্যোদয় আর শর্করাতেই তোমার মুক্তি আলোয় আলোয়।'



(২)

"একটা বেস গীটার কিনতে হবে আমাকে। মোহনবীণা, রুদ্রবীণা অবসোলিট এখন। এখন মিউজিক মানেই ডিজিটাল, মিউজিক মানেই ইউটিউব। কিছু গানের বইয়ের অর্ডারও দিয়ে এসেছিলাম গতবছর। দেখি পাই কিনা। এবারে রবিঠাকুরের জন্মসার্ধশতবর্ষ উদ্‌যাপনে একটা সিডি বের না করলে আর মান থাবেনা স্টুডেন্টদের কাছে,' ছোটমেয়ে বলে বসলে।

মা বললে "সিডি মানে তো অনেক খরচাপাতি। গান রেকর্ডিং, মিউজিক এরেঞ্জমেন্ট তারপর পোস্ট প্রোডাকশান, পাবলিশিং।'

"আরে আমার একটা নয়াপয়সাও খরচা হবেনা। আমি হলাম গিয়ে বাগ্‌দেবী। কৈলাসের তথা সারাভারতের বীণাপাণি। আমি শুধু গাইতে চাইলেই হল। আর আমার এই সিডি রবিঠাকুরের সার্ধশতবর্ষে হিট হবেই' ছোটমেয়ে বলে। "সেবার দেখলেনা? একটা বই লিখব বললাম। শ'য়ে শ'য়ে প্রিন্টার আর পাবলিশার আমার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি হলাম গিয়ে একটা ব্র্যান্ড বুঝলেনা? তবে আমার এই বই আর সিডির রয়্যাল্টি দিয়ে আমি কিন্তু এবার ফেরার পথে ফরেন ট্রিপে যাব এই জানিয়ে রাখলাম তোমাদের, "ছোটমেয়ে আবার বলে বসলে। বড়মেয়ে বললে "বাবারে তোর তো দেখি খুব শখ।'

ছোটছেলে চীৎকার করে বলে উঠলে "কোলের মেয়েকে বাপ-মা আদর দিয়ে মাথায় তুললে অমনই হয়। ছোটবেলা থেকে পড়াশোনায় ফার্স্ট, গানের গলা সুমধুর এতসব করে করে বেম্মা, বিষ্ণু, বাবারা কি কম আদিখ্যেতা করলে! আমার বেলাতেই বাবামায়ের যত ট্যাক্স বসানো। নবমীর রাতে আমি কিন্তু তন্ত্রে যাব। সেখানে আমার কত রাত হবে জানিনা, পরদিন ভোরের আগেই ফিরব। সেলফোন অফ থাকবে। আমাকে অযথা প্রশ্ন করবে না তোমরা, এই বলে রাখছি। দইকর্মার দিব্যি দিলাম। ভোর হলেই চলে আসব।'

বডভাই কান নাচিয়ে বললে "হ্যঁ¡, বাবা জানি জানি, তুমি দ্রাক্ষারসে অবগাহন করবে সে সময় তা এবার কত নম্বর গার্লফ্রেন্ডের সাথে নাচতে যাওয়া হচ্ছে শুনি? তাও যদি বুঝতাম একজন কেউ পার্মানেন্টলি তোকে ভালবাসে, তার চেয়ে তুই বরং ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টটা শিখে নে এবার গিয়ে। যেখানে যা অনুষ্ঠান হবে বিয়ে থেকে গানবাজনার জলসা, পুজো উদ্বোধন থেকে বিসর্জন আর কৈলাসের রম্ভা-ঊর্বশীর নাচের শো ... সবকিছুতেই বড় কাজে লাগে। হাতে পয়সাও আসবে আর শেখাও হবে।'

"কী আর করি বল, তোর মত একটা সুমো রেস্টলার মার্কা ফিগার তো আমার নয়। সলমনের মত বাইসেপ্স, হৃত্তিকের মত ট্রাইসেপ্স, এক রকম ফিগার মেন্টেইন করছি এত বছর ধরে। মেয়েরা ফিদা না হয়ে পারবে কেন?'

মা বললে "এই শুরু হয়ে গেল। যাবার আগে এত কথা কাটাকাটি না করলেই নয়? আমার এমনিতেই এখন এত ভুল হয়ে যায় আর তোরা ঝগড়া করলে আমি আরো ভুলে যাব। যাবার আগে তোদের বাবার রোজের সিদ্ধির স্যাশেগুলো নন্দীদের হাতে দিয়ে যেতে হবে। ভৃঙ্গিকে বলে দিতে হবে একটার বেশী ধুতরো ফল যেন না দেয়। বড়মেয়েটা আমার ঠিক বলেছে এবারে গঙ্গার আশেপাশে একটা বাড়ির ব্যাবস্থা না করে এলেই নয়। তোদের বাবার বয়েস হচ্ছে। কতদিন ওঁকে এভাবে ফেলে আর বছর বছর যাওয়া যায়।'



(৩)

বড়মেয়ে বললে "আচ্ছা মা, তুমি কি এবারেও অত ভারি সিল্ক পরে থাকবে ঐ ক'দিন? আমি কিন্তু পরছিনা এক্কেবারে। যা গরম সেখানে। এই ঠান্ডার থেকে গিয়ে আমার একেই দম আটকে যায় কেমন ক্লস্ট্রোফোবিক লাগে। আমি এবার সুপারনেট, হালকা গোলাপী রঙের। আর তুমি বরং পিওর শিফন পরো। অমন সাদা খোলে লাল পাড়ও পাওয়া যায়। নো জরি, নো সেকুইন্স। ওসব আউট ডেটেড। সিম্পল প্রিন্টেড শিফন ৪০ গ্রাম। হ্যঁ¡রে, তুই কী পরবি ঠিক করলি এবার?' ছোটবোনকে জিগেস করলে।

"আমি একটা ঢাকাই মসলিন পরব হলুদ রঙের। বঙ্গের উৎসবে ঢাকাই মসলিন না পরলে ইজ্জত থাকেনা। একে তো বাবা চাকরী-বাকরী করেনা, নেশাটেশা করে বলে মামারবাড়ির সকলে আমাদের একটু হেয় করে। সেখানে শিফন-টিফন, সুপারনেট পরলে মান থাকবে মা? তার চেয়ে চলো তিনজনেই ঢাকাই পরি। হালকাও হবে ইজ্জতদারও হবে,' ছোটমেয়ে বললে।

"ভাবছি এবার আর দশহাতার ব্লাউজ করাব না। আমার স্পন্ডেলোসিসের ব্যাথাটা যা বেড়েছে অতগুলো হাতা পরতে বড্ড কষ্ট হয়। আর ঐ গরমে অতগুলো হাতার ব্লাউজ পরে থাকা যে কি ঝকমারি!' মা বললে।

"তোমায় তো কতবার বলেছি মা, এখন ওসবে কেউ কিস্যু ভাববেনা। এখন ওখানে বুড়িরাও বাড়িতে দিনে নাইটি পরে, বাজারে জিনস পরে, রাতে লঞ্জারে পরে। বাড়ির বৌয়েরা বিকিনি বেশে সুইমিং পুলে যায়। ওরা এখন আগের থেকে অনেক লিবারাল। কেউ শাঁখা সিঁদুর পরেনা,' ছোটমেয়ে বললে।

"তোরা যতসব সাজগোজ নিয়ে পড়ে আছিস এখনো, ওদিকে জানিস? ফেসবুকে নাম না থাকলে এয়ারপোর্ট থেকে বের করে দেবে আমাদের। প্রত্যেকের ছবিশুদ্ধ একাউন্ট খুলে ফেল আগে,' ছোট ছেলে শশব্যাস্তে এসে ঘোষণা করলে।

"বেশ তো, আমার তাতে আপত্তি নেই। শুনছিলাম ফেসবুকে নাম না থাকলে স্বর্গেও আর ঠাঁই হবেনা আমাদের,' মা বেশ চিন্তায় পড়লেন।

"হ্যঁ¡রে এই নেটটা কি দিয়ে তৈরী রে?' বড়ছেলে জিগেস করলে। "আমার ইঁদুরটার সুবিধে টুবিধে হবে তো?' ছোট বোনটি হি হি করে হেসে বললে "এ নেট সে নেট ন, এ জাল মহা জাল, যন্ত্রজাল। ইঁদুরে না পারে কাটতে, চোরে না পারে ভাঙতে তবে হ্যাকার পারে টপকাতে।'

"হ্যাকার কী রে?' মা বললে।

"নেটের আতঙ্কবাদীদের হ্যাকার বলে,' মেয়ে বলে দিলে মা'কে।

"আরেকটা কথা আজকাল খুব শুনছি এখানে, দাঁড়া মনে করি। সাইবার কোথায় রে? পুরী-মোহনভোগ কী কসম! কাউকে বলবনা। প্লিজ বল আমাকে,' মা বললে।

অমনি সবজান্তা বড়ছেলেটা শুঁড় নাচিয়ে জবাব দিলে, "এ মা তাও জানোনা? মামাবাড়ি যাইবার, লাড্ডু খাইবার আর অপরাধের সাইবার।'



(৪)

রবিঠাকুরের জন্মসার্ধশতবর্ষে তাঁর মৃত্যুদিনে শ্রাবণ-শ্রাদ্ধ সমারোহের যা ঘটা শুনছি তাতে এবার উনিই নাকি হবেন থিম নাম্বার ওয়ান। কুমোরপাড়ায় নাকি সীসে-বর্জিত রঙ লাগানো হচ্ছে যেটা হবে ইকোফ্রেন্ডলি থিম নাম্বার টু। ওসামার পতন আর ওবামার উত্থানেরও থিম হবে প্যান্ডেলে যা হবে থিম নাম্বার থ্রি। শোনা যাচ্ছে, ভারতের বিশ্বকাপ আনা থেকে ইংল্যান্ড সফরে মুখে চুনকালি হবে থিম নাম্বার ফোর। বদলের বঙ্গে পরিবর্তনের জোয়ারে দিদি নাম্বার ওয়ান হবেন থিম নাম্বার ফাইভ। আরো শোনা যাচ্ছে লোকপালে হাওয়া দিয়ে রামলীলা ময়দান হবে থিম নাম্বার ছয়। তারপর বাঙালীর মায়ের চেয়ে মেসির জন্যে যা দরদ দেখছি তাতে মনে হয় মেসির বঙ্গে আগমন তো আছেই। এই থিম পুজোর শুচিবায়ুতায় মা তার ছেলেপুলেদের নিয়ে ভালোয় ভালোয় এসে আলোয় আলোয় ফিরে গেলে বাঁচি।

থিম থিম করে পাগলু হয়ে পুজোয় চমক হবে। দেব-দেবীদের চক্ষু চড়কগাছ। হিংসায় উন্মত্ত ধরায় শান্তির বাণী বর্ষাতে এসে সব প্ল্যান ভন্ডুল। পিচঢালা ঝকঝকে রাস্তায় প্যান্ডেলের খুঁটি পোঁতা হবে। হোতারা গর্ত খুঁড়েই খালাস হবেন। মা চলে যাবার পর সেই গর্তগুলোর কী হবে তা নিয়ে কেউ ভাববেন না একটিবারও। একই পাড়ায় চারটে দলের আলাদা আলাদা পুজো হবে। দলবাজির মা, রকবাজির মা, রঙবাজির মা, দাদাগিরির মা। আফটার অল ভাগের মা বলে কথা। গঙ্গা পাবেন অবিশ্যি। কিন্তু গঙ্গার কী হবে? একেই তো বুঁজে আছে পর্যাপ্ত প্লাস্টিকে। ক্লিন কোলকাতা, গ্রিন কোলকাতা থিম ততক্ষণে বিসর্জন। মহানগরের ড্রেনগুলি আবার ভর্তি হয়ে যাবে। ঠাকুর দেখবেন প্রচুর দর্শনার্থী। জলের বোতল, কোল্ড ড্রিংক্সের বোতল, কফির কাপ, আইসক্রিমের কাপ, আরো কতকিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে তারা রেখে চলে যাবেন এই মহানগরের রাস্তাঘাটে। তেরঙ্গা, গুটখা, শিখরময় হয়ে উঠবে এই মহানগর। চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙে মাইক্রোফোনের স্পীকারে গান বাজতেই থাকবে উচ্চৈ:স্বরে। হোতারা বলবেন "বাজাতে রহো'। সদ্যোজাতের কর্ণপটাহে তালা লাগবে সেই শব্দে। আলোর রোশনাই কোজাগরীর চাঁদের জোছনাকে আড়ালে রাখবে। বিদ্যুৎ বিদ্যুৎ বিদ্যুৎ! কত চাই এসময়ে? জয়েন্ট পরীক্ষার আগের দিন না হয় অন্ধকারে ডুববে বঙ্গ তাই বলে পুজোতে আঁধার আমার ভালো লাগবে কি? রমরমিয়ে ব্যবসা চলবে ট্রান্সফ্যাটের। আবার ওজন বাড়বে বাঙালীর। পুজো তো রোজ রোজ হবেনা। তাই বলে কি রসনা অতৃপ্ত থাকবে? চক্ষুশুদ্ধি হবে প্যান্ডেল হপিং করে। জিনস-কুর্তা, কুর্তি-কেপরি, স্কার্ট-লাচ্ছায় লাস্যময়ী, হাস্যময়ীরা মাতাবেন ম্যাডক্স স্কোয়ার, তিনকোণা, দেশপ্রিয়, বাদামতলা, মুদিয়ালি। ছিনেজোঁকের মত মানুষ ভীড় করবে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে। ততক্ষণে মা উধাও সেই প্যান্ডেল থেকে। পড়ে থাকবে মৃন্ময়ী মূর্তি। চিন্ময়ী মায়ের বিরহী আত্মাটুকু পাড়ি দেবে দয়িত ভোলেবাবার কাছে। ভীড়ভাট্টা থেকে রক্ষা পাবে বলে। কোলকাতার ভূষণ হবে দূষণ। মাননীয় নেতারা বিজয়া টিজয়া সেরে টেরে সিদ্ধান্ত নেবেন। মহানগরকে দূষণ মুক্তকরার জন্য অনেক মিটিং হবে। ততক্ষণে শারদসম্মান অ্যাওয়ার্ড সেরিমনি শেষ।

আকাশতলে, অনিলে জলে, দিকে দিগন্তলে, বনে বনান্তরে বাজতে থাকবে "বলো দুগ্গা মাইকী জয়! আসছে বছর আবার হবে!'

নাড়ু মুখে, পান হাতে, সিঁদুর খেলে মা মুচকি হেসে বলবেন "আবার আসিব ফিরে ধানসিঁডিটির তীরে এই বাংলায়।'

সিংহমশাইয়ের পিঠে চেপে মা, মায়ের দু জোড়া ছেলেপুলে, একাই একশো উগ্রপন্থী মহিষাসুর আর এক গন্ডা নির্বিবাদী পশুপাখি বাক্স প্যঁ¡টরা প্যাক করে রেডি হয়ে জুলজুল করে দেখছে তখন। কোথায় পাব বলরাম-যুগল? কোথায় পাব বাঞ্ছারামের পান্তুয়া? হায়রে সেনমশাইয়ের মিষ্টি দৈ! যাদবের দিলখুশ আর কেসি দাসের রসোমালাই।

মা বললেন "চলো চলো চলো সবে, কৈলাসে গিয়ে হবে, চমরীর দুধে মিষ্টিমালাই, বানাবো সকলে খাবে।'

বড়মেয়ে বললে "শুধু যাওয়া আসা, শুধু পয়সা খসা।'

ছোটমেয়ে বললে "চল রাস্তায় নামি ট্রামলাইন...'

বড়ছেলেটা বলে বসলে "আহা কতদিন শুনতে পাবনা এ সব, বড্ড মিস করব রে!'

মা কোলের ছেলেকে বললেন "কী রে তুই কিছু বল?।'

অমনি ছোটছেলে বললে "আমাকে আমার মত থাকতে দাও মা, কিচ্ছু ভাল্লাগছেনা।'

পাড়ার ছেলেমেয়েরা দৌড়ে এসে খবর দিল "আই এসডি কল এসেছে মাগো, একটিবার চলো। বোধহয় কৈলাস থেকে শিবুদা ফোন করেছে।'


(গুরুচন্ডা৯, পুজো ইস্পেশাল-২০১১  )

বেশ করেছি ! মাই চয়েস!!

মনে পড়ে কবীরসুমনের সেই বিখ্যাত গান "সব আমাদেরি জন্যে, আমাদেরি জন্যে..."  । ভিনরাজ্যে গিয়ে থেকে তো দেখেছি মশাই। এই চৈত্তসেলের জন্যে ফাগুণ পড়তেই মন কেমন উশখুশ করে!  এমন সেলের পসরা কোথাও পাবে না কো তুমি। সেবার সেই বাম জমানায় সুভাষবাবুর তাড়ায় অপারেশন সানশাইনের কবলে পড়ে রাতারাতি গড়িয়াহাট খালি । ফাগুণে সে বিরহব্যথা যে কি জিনিষ তা আমি বুঝি।  । কোথায় আমার পায়জামার দড়ি! কোথায় গেল জামাকাপড় শুকোনোর ক্লিপ্! কোথায় পাই আমার সাধের জাঙ্ক জুয়েলারি, টিপ-ক্লিপ আর কুশন কভার? আর পয়লাবৈশাখে বাড়ির দোরে নতুন ডোরম্যাট? কিনব‌ই তো ! মাই চয়েস! 

কি ভালো ছিল আমার সেই হকার ভাইটা! মাঝবয়সী আমাকে এখনো বৌদি বলে ডাকে।  একবাক্যে জিনিষের দাম আর্ধেক করে হাসিমুখে বলে, নিয়ে যান, পরে দাম দেবেন। এত আন্তরিকতা কোথায় পাব বলতে পারো? তাই ওকেই আমার এত পছন্দ। মাই চয়েস! 

মায়ের মলমল ছাপাশাড়ি আর শ্বশুরমশাইয়ের হাফপাঞ্জাবি না হয় কিনলাম দোকান থেকে। তাই বলে নিজের হাউসকোট কিম্বা কাজের মেয়ের ম্যাক্সি? কক্ষণো নয়। বেঁচে থাক ফুটপাথ! আর ওখানে কেনার চার্মটাই আলাদা!  কত্ত চয়েস! কত্ত আন্তরিকতা হকার ভাইদের!চাকরী জোটেনি তাই টিউশানির পয়সায় আমার গুড টাইমপাস। আমি বড়বড় দোকানের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত উইন্ডোয় চোখ রাখি আর উইন্ডো শপিং করি। কিন্তু কিনি ফুটপাথ থেকে। আমার হকার ভাইটিও বিএ পাস করে হকার হয়েচে। গর্বের সাথে বলে সে।    হকারকেই আমার দরকার এই চৈত্তসেলে, কুর্তির ঝুলে। এইজন্যেই তো পড়ে র‌ইলাম কলকাতায়।  তাও মাই চয়েস! 

এই শহরটার জন্মলগ্নে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৃহস্পতি তুঙ্গে জানেন তো? তাই কর্তা নামেন বালিগঞ্জ স্টেশনে, গিন্নী নামেন গড়িয়াহাটে।  তারপর ছুঁচোর ডন বৈঠক  দেওয়া পেটে ঐ ফুটপাথের এগরোল কিম্বা চাউমিন, মোমো কিম্বা ফিশফ্রাই সাবাড় করে চৈত্তসেলে পথ পেরোন তাঁরা। আহা কি আনন্দ তখন সেই পথচলায়! যিনি মেট্রো করে নামেন রাসবিহারী তাঁর জন্য আছে রাসবিহারীর বিস্তীর্ণ দুপারের প্লাসটিক বালতি, মেলামিনের বাসন থেকে কাটগ্লাসের সুরাপাত্র, বাথরুম সেট, পুরণো ম্যাগাজিন থেকে পাইরেটেড সিডি, রেডিমেড ব্লাউজ, সায়া থেকে শার্ট-প্যান্টের পিসে ঢালাও সেল। কি চাই! রাসবিহারীর মোড় থেকে রসা রোডের দিকে কালীঘাট  পেরিয়ে হাজরা আর এপাশে দেশপ্রিয় পার্ক পর্যন্ত সেলে ডুবে আছে মহানগরী। ভেতরের জামা, বাইরের জামা, পর্দার কাপড়  সবেতেই সেল। গয়নার মজুরি ফ্রি। আবার সোনা কিনলে সম ওজনের রূপো ফ্রি! ভাবা যায় এই পয়লা বৈশাখের কি মহিমা? 
 
ওদিকে বঙ্গললনার এখন টেলিভিশনে মাস্টারশেফ দেখে দেখে বড় সাধ জাগে একবার কন্টিনেন্টাল কিম্বা ইটালিয়ান বানানোর। বিশ্বায়নের  ঢেউ লাগা সাফসুতরা রাস্তায় এখন বাটন মাশরুম থেকে বেবিকর্ণ, সুইট কর্ণ থেকে ব্রকোলি, তেরঙ্গা সিমলা মির্চ কি না পাওয়া যায়! 
 কেউ নামেন শ্যামবাজার মেট্রো স্টেশনে। তাঁর গার্ল ফ্রেন্ড হয়ত কলেজ ফেরত আসেন সেথায়। তারপর শুরু হয় সেল পরিক্রমা। আদিগন্ত হাতীবাগান জুড়ে সেল, সেল, সেল। আর সে যুগে যারা স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের অমোঘ বাণীকে পাথেয় করে ব্যবসায় নেমেছিলেন  তাদের দোকানে হাহুতাশ!  নিউমার্কেটে তারা নাকি অবস্থান করছেন হকারদের বিরুদ্ধে। আরে বাবা ! বোঝেনা সে বোঝেনা।  তার বাপ-ঠাকুরদার এদ্দিনের ব্যাবসাপাতি নাকি হকারদের কল্যাণে লাটে ওঠার উপক্রম! ক্রেতা বলেন  যেখানে সস্তা পাব, সেখানে যাব। বিক্রেতা বলেন এসি দেব, ভ্যাট নেব, রসিদ দেব। আর নেতা বলেন হকার আমার মাটি। হকার আমার ভোট। হকার আমার ভাগ্যনিয়ন্তা। "সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই".... সেই কোন্‌ যুগে চন্ডীদাস বলে গেছেন।  সুভাষবাবুর অপারেশন সানশাইনের পর হকার পুনর্বাসন হয়েছিল। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি জানেন? কেউ যায়নি নতুন বাড়িতে। ক্রেতা খোঁজে সস্তার জিনিষ। বিক্রেতা চায় বিকোতে। কারণ এ শহরে শিল্প আসেনি তেমন করে। তাই ইকনমিক গ্রোথ হয়নি বুঝি। তাই ক্রয় ক্ষমতা বাড়লনা বোধহয়। তাই ফুটপাথেই উঁকিঝুঁকি আর হাতড়ে মরা সাধের জিনিষগুলোর জন্যে। 
ওদিকে উঁচু উঁচু শপিং মলের বাতানুকুল বায়ুমন্ডলে ম্যানেকুইন ডুকরে কাঁদে। পথিক আসে দর্শক হয়ে। চোখ বুলায়, হাত বুলায়। পিছন পানে চায়। সেখানেও সেই এক অছিলা। মাই চয়েস!  

এতো গেল পথেঘাটে প্রাক্‌বৈশাখী প্রস্তুতি।  চাদ্দিকের  চৈত্তসেলের হাতছনি। এবার আসি ডিজিটাল সেল প্রসঙ্গে। সেখানেও নানান অফার। সবকিছুই বর্ষবিদায়ের আনন্দে।  গড়িয়াহাটার মোড়ে, হাতিবাগানের ধারে কিম্বা নিউমার্কেটের আশেপাশে নয় কিন্তু।  শ্যামবাজারে বা কসবাতেও নয়। এ হল আমাদের ডিজিটাল চৈত্তসেল। সেল, সেল, সেল, ফেসবুক পাড়ার সেল । দুটাকা বাঁচানোর সেল, পয়লা বৈশাখী সেল।  এই এক হয়েচে বাপু। প্রতিবছরে চৈত্র গিয়ে বৈশাখ আসবে আর তার জন্যে বছরের বস্তাপচা জিনিষ পত্তরের স্টক ক্লিয়ারেন্স সেল হবে। তুমি বাপু বিক্কিরি কত্তে পারছোনা তাই দাম বাড়িয়ে সেল ঘোষণা করেছ আর আম-আদমী ভাবছে কি সস্তা! কোথায় লেডিজ প্রিমিয়াম টপস পাওয়া যাচ্ছে দুটো, একটার দামে।  "বাই ওয়ান, গেট ওয়ান" যাকে বলে।  কোথাও আবার বিক্রি বাড়াতে হবে বলে বাই টু গেট টু।   ঐ দোকানে বেষ্ট ডিল অফ ইয়ারিংস। আসলি মুক্তো, আসলি জারকোন  মাত্র ঐ দামে? নো ওয়ে! এমন স্বপ্ন কখনো দেখিনি আমি!  কুর্তা, কুর্তি অনবরত দৃষ্টি কেড়ে নেয় । কারে ছেড়ে কারে ধরি!  আনারকলি, নূরজাহান সকলেই আছেন এক ছাদের নীচে। শুধু অপেক্ষা একটা ক্লিকের। 
পোলকা ডটের কুশন কভার, হালকা-পুলকা কস্টিউম জ্যুয়েলারি, প্যাস্টাল শেডের সুদৃশ্য বেডস্প্রেড এমন কি গৃহসজ্জার দৃষ্টিনন্দন আর্টিফ্যাক্টসও, বুদ্ধ-গান্ধী-বিবেকানন্দ সকলেই উপস্থিত!  সখের পোশাকী চটি জোড়া থেকে হাঁটার জন্য  গুরুগম্ভীর স্নিকার্স, রান্নাঘরের ঘটিবাটি থেকে পড়বার ঘরের তাক, ময়লা ফেলবার ভ্যাট। সবেতেই সেল দিচ্ছে তারা সারা বছর ধরে। শুধু তোমার ক্লিকের অপেক্ষা। আর তারপর এড টু কার্ট, ব্যস! বেশ করব কিনব। মাই চয়েস!  

চৈত্রসেল পেরোতে পেরোতেই বৈশাখী হেঁশেলের তোড়জোড়। মোচ্ছব সেখানেও। হোটেলে হোটেলে রসিক বাঙালীর খাদ্য বিলাস। শুরুতেই কাঁচা আমের জুসের সাথে ভদকার অভিনব ককটেল।অথবা তরমুজের লাল রসে পুদিনার সবুজ। ওপর থেকে আধ পেগ হোয়াইট রাম।   যাকে বলে ফিউশান শরবত। তারপরেই লুচি, বেগুনভাজা, শাক-শুক্তো-ছ্যাঁচড়া-মুড়িঘন্ট। পরের দফায় ঘি ভাত, তপসে ফ্রাই। নির্গুণ, নির্গন্ধা বেগুণ দিয়ে বেগুণ বাসন্তী থেকে শুরু করে সারাবছর অচল পটলের দোলমা। ঘিভাতের কত রকম নাম হয় আজকাল! সে কখনো দারুচিনিদেশে, কখনো মখমলি জুঁইফুলের বাগিচায়। গাছপাঁঠার মুইঠ্যা তো পনীর পসন্দ।  যশুরে তেল কৈ কিম্বা বরিশালী ইলিশ। কোথাও মৈথিলী ভেটকি, কোথাও আবার মাটন মনোহরা। শুধু চমকে যাওয়া নামের অভিনবত্বে।  মধুরেণ সমাপয়েত ম্যাজিক মিহিদানা অথবা রসোগোল্লার পুডিং দিয়ে। আরো ভালো যদি থাকে  জলভরা জলপরী কিম্বা  দৈ কলসের ঠান্ডা ছোঁয়া।  আর তারপরেও চালিয়ে দেওয়া যায় কেশরীয়া মালপোয়া কিম্বা যুবতী এক জিলিপিকে। ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব স্বয়ং বলেছিলেন ভরাপেটেও জিলিপি জিভ থেকে টুকুস করে, অতি অনায়াসে গলার মধ্যে দিয়ে সোজা পেটে চালান করা যায় । যেমন খুব ভীড়ে লাটসাহেবের গাড়ির চাকা ফাঁকফোকর দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে যায় সাবলীল গতিতে। 
সব শেষে বলি এবারের বৈশাখী শ্লোগান হল পুরভোটের। থুড়ি মেয়েদের জন্যে। স্থলে-জলে-অন্তরীক্ষে আমি আছি আমার পছন্দ নিয়ে। মাই চয়েস! বেশ করেছি, ফুটপাথ থেকে জিনিস কিনেছি, মাই চয়েস! বেশ করেছি হকারকে প্রশ্রয় দিয়েছি। মাই চয়েস! ডিজিটাল শপিংও করেছি অনেক। কারণ মাই চয়েস। পার্সে ক্রেডিট আর ডেবিট কার্ড। আমাকে আর পায় কে? বৈশাখে খাদ্যবিলাসেও সামিল হয়েছি কারণ মাই চয়েস! হোমমেকারের হেঁশেলের চাক্কা বন্ধ পয়লা বৈশাখে। কারণ মাই চয়েস! রাঁধছিনা, রাঁধবনা। আজ স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ সব তোমাকে দিলাম পয়লা বৈশাখ। কারণ মাই চয়েস!   

( আনন্দবাজার ইন্টারনেট, পয়লা বৈশাখ

পুজোর বাজার ও ফেসবুকীয়

  যাঃ ছাতা! ধুস্‌  ! এমন জলেকাদায় পুজোর বাজার হয় নাকি?  বিষ্টি ব্যাটাচ্ছেলে এভাবেই দাপিয়ে চলবে পচা ভাদ্রের পুজোবাজারে?  দোকানিদের হয়রানি আর বিক্রেতার ঝামেলা। শুধু শপিং মলে আর বাড়ির মধ্যে বুটিকগুলির খুব মজা। বিরক্তি সবেতেই। শপিং মলে বৌদিরা দরদাম করতে পারেননা বলে মনখারাপ। আবার শপিংমলে বিষ্টি থেকে রেহাই। বাতানুকুল পরিবেশে মনটাও ফুরফুরে থাকে। ব্লাডপ্রেসার বাড়েনা। তবে দামটা...
আর তুমি ফুটপাথে বারগেন করেছ বলে ভাবছ খুব জিতেছ তাইনা? মোটেও না। ফুটপাথের জিনিসে সস্তার তিন অবস্থা। পুজোয় পরো। জলে দাও তারপর ভুরভুর করে রং গেল উঠে। অথবা মহাষ্টমীর রাতেই সেলাই গেল ফেঁসে। কিম্বা নবমীর নিশিতে আবিষ্কার করলে শাড়িটার আসলে ব্লাউজপিস ছিলনা। ব্লাউজপিস কেটে দশহাতিতে দাঁড়িয়েছে। ষষ্ঠীর ভোরে বিছানার চাদর পাততে গিয়ে দেখলে সাত বাই পাঁচ খাটের চাদর গচিয়েছে তোমাকে সাত-ছয় বলে। আবার সপ্তমীর সন্ধ্যেবেলায় ছেলে বন্ধুদের সাথে বেরুতে গিয়ে দেখল অতি পছন্দের টিশার্টটা আসলে এক্সেল নয়, আদতে তা স্মল সাইজ।  তারপর কুর্তির ঝুল, ফুর্তির মেজাজ, সোঁয়া ওঠা ঘিচা, মিসপ্রিন্ট কোটা,  ফুটোওলা মসলিন, সুতো সরে যাওয়া পশমিনা আর আহারে আমার বাহা শাড়ি!
ফেসবুকের রোশনিতো সেদিন ফুটপাথ বনাম শপিংমল নিয়ে পোষ্টেছিল স্টেট্যাসে। ব্যাস্! ঝড়ের বেগে পড়ল কমেন্ট। ফুটপাথকে ছোট করতে চায়না কোনো বঙ্গললনা। রোশনীর বন্ধু সায়নীতো আলটপকা বলেই ফেলল "রাখ‌ তোদের শপিংমল! আমার খাদির তসরের পাঞ্জাবীর রং উঠে শেষ। কটন কুর্তি জলে পড়ে হাঁটুর ওপরে উঠেছে আর কটন ইন্ডিয়ার পর্দাটায় একটা করে সিন্থেটিক সুতো আছে।
এবার বোঝো ঠ্যালা।
রোশনী ফুটপাথের ও ফরে নয়। সায়নী দোকানেরো ফরে নয়। ওদের দুজনের কমন ফ্রেন্ড বনানী ফুটপাথ আর দোকান দুটোতেই স্বাছন্দ্য বোধ করে। সেই নিয়ে কে যে ফুটপাথের হকারদের বিরুদ্ধে বলবে আর  কে শপিংমলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে তা বুঝে উঠতে পারেনা। হকারদের ফরে কথা বললে পাবলিক বলবে বর্তমান সরকারের ভাড়া করা ক্যাডার। শপিংমলের ফরে বললে বলবে অপোজিশনের চর। অতএব সেই কাজিয়া তুমুল থেকে তুমুলতর হল। 
অঞ্জলির ভোরে যাদেবী সর্বভূতেষু   বলতে বলতে চোখ বুঁজে ফুল ছুঁডতে গিয়েই বগলে টান পড়ল হেঁইও বলে। ব্যাস্!  আনকোরা রেডিমেড তসরের পাঞ্জাবীর বগলের দফা গয়া। বৌ সেই দেখে বলে উঠল
" ঠিক হয়েচে, আবারো যাও তোমার দামী দোকানে।  এবার কি হবে?”
বলতে বলতেই বিষ্টির জলে রাস্তা থৈ থৈ। এবার কত্তা-গিন্নী অঞ্জলী দিয়ে খালিপেটে রাস্তা পেরিয়ে যাবে কচুরীর দোকানে। ব্যাস্!  থ্যাপ্‌, থ্যাপ্‌! চুপচাপ ফুলে ছাপের মত গিন্নীর গরদে ক্লড মোনের ইম্প্রেশানিষ্ট পেন্টিং!    গিন্নীর লুটোনো সিল্কের গরদে ব্রাইট পাড়ের রং লেগে গেল শাড়ির সাদা জমিনে! কর্তা বলে, এবার দেখো, তেরে জমিন পর্! ঐ গড়িয়াহাটার ফুটপাথের দেওরগুলো কেমন গরদ গচিয়েছে দ্যাখো দিকিনি! বৌদি বৌদি বলে অজ্ঞান ছোঁডাগুলো।  যেন মাইরি মাইরি কচ্চে ছোঁড়াগুলো! 
তখন পেটে খিদের জ্বালা আর তাতে শাড়ির রং তোলা এই টানাপোড়েনে কর্তা-গিন্নীর অষ্টমীপুজো শিকেয় উঠল। 
শাড়ির দোকানেও দালালি করে ঐ দেওরগুলো! বৌদি এই দোকানে আসুন, অপর্ণা সেনের প্রিয় দোকান। নয়ত বধূঠাকুরাণীর হাটে আসুন। মুনমুন সেন এখান থেকে শাড়ি কেনেন। অথবা আরো লোক টানতে সোজা বলিউড পৌঁছে যায়। বাংলার মেয়ে রাণী মুখার্জি পোত্যেকবার পুজোর আগে আমাদের এই দোকান থেকে ঢাকাই কিনে নিয়ে যান। ঐ যে বালীগঞ্জ কালচারের সামনে কাহানীর স্যুটিংয়ে সব লাল-সাদা গরদ্ গুলো দেখেছিলেন বৌদি ওগুলো সব আমাদের দোকানের... বিদ্যা বালন  এবারে দশখানা গরদ মুম্বাইতে  কিনে নিয়ে গেলেন । তুমিও গলে আইসক্রিমের আনন্দে ঐ গরদ কিনে ফেললে । এবার লে ছক্কা!  ব্যুটিক শাড়ি বৌদি। পোত্যেকটা ইউনিক পিছ। ডুপ্লিকেট হবেনা আমাদের কাপড়। গতবারেও তো ঠকেছিলে গিন্নী। মটকা না ফটকা কি একটা বলেছিল তোমাকে। পরে দেখলে ওটা আসলে নিপাট পাটের শাড়ি। দোকানের আশেপাশেই অপেক্ষা করে থাকে । ঝোঁপ বুঝে কোপ মারে। বেশ গোবেচারা, ভালোমানুষ দেখে দালালের চৌম্বকীয় টান সম্মোহন বিদ্যার ভেলকিতে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে যায় সেই দোকানের দরজার দিকে। ব্যাস্! একবার নিয়ে যেতে পারলেই সেদিনকার মত একটা দালালিতো পাবেই সে ।
তার আর কি দোষ বলো? গিন্নী বলে ওঠে। চাকরীবাকরী নেই, শিল্প নেই, কলকারখানা যাও বা ছিল সব বন্ধ হয়ে লাটে উঠেছে সে লোকটাকেও তো করে খেতে হবে। সে তো আর চুরি করছেনা! 

আর তুমি বুঝি ঠকোনি? ঐ এসির লোভে নামী  দোকান থেকে গতবছর সুতির পাঞ্জাবী কিনে নিয়ে এসে পরে  দশমীর ঠাকুর ভাসান থেকে ফিরলে ! সারা গায়ে আমবাতের মত দাগড়া দাগড়া ঘামাচির মত ছাইপাঁশ বেরুলো! ডাক্তার তো ভয়ে তোমাকে ষ্টেরয়েড দিয়ে দিতে বাধ্য হল। সিন্থেটিক পাঞ্জাবী পিওর কটন বলে চালিয়ে দিল আর আবার এবছর ওদের দোকান থেকেই তসরের পাঞ্জাবী কিনলে অত্ত দাম দিয়ে?  
পুজোর বাজার, সাজুগুজুর রমরমা, একসেসারিজ, মেহেন্দী, স্পা সব মিলিয়ে ঘেঁটে ঘ ফুটপাথ। কি সব আগডুম বাগডুম রংকে মেহেন্দী বলে  লাগিয়ে রোশনীর কাজের মেয়েটার দুহাত ফুলে সুমো রেস্টলারের সাইজ!  চুলকে মরে গেল মেয়েটা। বাসন মাজা, কাপড়কাচা, ঘরমোছার হাত বলে কতা। এখন রোশনীকেই সামাল দিতে হচ্ছে। তাই কাজের ফাঁকেই উগরে দিল খানিকটা ফেসবুক পাড়ায়। বারণ করেছিলাম ওকে, শুনলোনা। এবার একাহাতে ডাক্তারবদ্যি প্লাস কাজগুলো সব সামলাচ্ছি বন্ধুরা... ।

বলতে না বলতেই পড়ল কথা সবার মাঝে, যার কথা তার গায়ে বাজে। সায়নী বলল ঐ মেহেন্দীওলাকে পুলিশে দেওয়া উচিত! বনানী বলল আরে গতবছর গড়িয়াহাটের ফুটপাথে ট্যাটু করতে গিয়ে আমার ড্রাইভারটার সে কি বিপত্তি। গাড়ি চালানোর হাত বলে কথা। বিষিয়ে গিয়ে কেলেঙ্কারি।
 রোশনী, সায়নী ও বনানীর কমন ফ্রেন্ড উজ্জলদা বললেন রেজিষ্ট্রেশান নেই কিছুনা,  সকলেই বিজনেস কচ্চে কলকাতার ফুটপাথে। বাঙালী জেগেছে, প্রফুল্লচন্দ্রের কথা মাথায় নিয়ে বাণিজ্যে বসেছে বাঙালী।   সস্তার জিনিষ, সস্তার রং ব্যাবহার করে মানুষকে বোকা বানাচ্ছে আর আমাদের সরকার ? তাঁর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই সেদিকে? সাথে সাথে পটাপট উত্তর ফেসবুক দেওয়ালে।
আরে মশাই, সরকার রাজ্য শাসন করবে না মেহেন্দীর রং গুলবে? রাস্তা সারাবে না কি ট্যাটু নিয়ে রিসার্চ করবে?  সরকারকে মিছে দোষ দেন আপনারা! এই হল আপনাদের এক মহাদোষ! দেখছেন টালার জলট্যাংকি রং হচ্ছেনা কত বছর ধরে, আর তিনি কিনা মেহেন্দীর রং নিয়ে পড়ে থাকবেন !

তাহলে তো ফুটপাথের মোমো বিক্রেতা থেকে শুরু করে আখের রস সকলকেই জেলে পুরতে হয়। জনৈক ফেসবুকার বলে... 
আরে দাঁড়াও তেনারা নিজেরাই ল্যাজে গোবরে। সারদা মায়ের নাম নিয়ে  ব্যবসায় নেমে কি ঝক্কি বলো দিকিনি!  আরেকজন বলল, সব কপাল বুঝলে ভায়া? বাজার যাবার সময় রোজ বস্তির একটা মেয়েছেলে সকলকে ফুঁসলোত, আমি নিজের চোখে দেখেছি গো। বাজারের আলু ওলা, পটল ওলা সকলের কাছ থেকে দশটা করে  টাকা  কালেক্ট করত। আর তোতাপাখির মত বলে যেত, রোজ দশ করে দাও, সারদা লাখপতি বানাবে তোমাকে। আমার নিজের কানে শোনা এসব।   

বলিহারী ফেসবুক বাপু! কারোকে ছেড়ে কতা কোস্‌ না তোরা। বনানীর মা মেয়ের  ল্যাপটপের পাশে বসে ফোড়ন কাটেন। চড়বড় করে ফোড়ন যেন ছিটকেই আছড়ে পড়ে এলসিডি স্ক্রিনে। এই গেল শূয়োরের বাচ্ছাদের নিয়ে মায়েদের রিহ্যাব নিয়ে, তারপর পাল নিয়ে টালমাটাল দিনকয়েক, তারপর ছাত্রদের ত্রি-শঙ্কু অবস্থা হয়ে ঝুলে থাকা,  আর এখন তো টিভি খুলতেই পারছিনা ...সারদা-রামকৃষ্ণতে অরুচি ধরে গেলরে! তাই তো টিভি বন্ধ করে তোর পাশে বসে ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখশুদ্ধি করছি।

তাই করো মা, ফেসবুকে ঢুকে পড়ো টুক করে!

যাই বাপু আজ্! ওদিকে পাড়ার প্যান্ডেলে আজ পুজোর মিটিং আছে। আমাকে সভানেত্রী করেছে ওরা। তিলোত্তমার মেয়ের বিয়ে বলে কতা! বছরে তো একবার । ফেসবুক তো বারবার !
("এইসময়" ব্লগ )

বেঙ্গল পুজো লিগের প্রস্তুতি


"পুজোটা এবার বড্ড তাড়াতাড়ি, ধুস্‌ ভাল্লাগেনা, জলেকাদায় এবার আমাদের যে কি হবে!  জলে ডুবে কলকাতার প্যাচপ্যাচে পথঘাটে পা মচকে সেবার আমার কি করুণ অবস্থা হল! আগের বছরের খুঁটিপোঁতার গর্ত এখনো বোজায়নি আর সেখানেই পা পড়ে ...তারপর সেখানে প্রোমোটার রাজের কৃপায় রাস্তায় চলাই দায়। স্টোন চিপস, বালি, ইঁট-কাঠে বোঝাই রাস্তার দুপাশ, ফুটপাথে হকার, খালপাড়ে ঝুপড়ি । তবে সেখানকার মানুষজন তোমাকে বড় ভক্তিছেদ্ধা করে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে একটা বট কিম্বা অশ্বত্থগাছ হলেই তোমাকে পিতিষ্ঠা করে ওরা। আমি তো সেখানে পাত্তাই পাইনা। এই বছরে একবার যা পুজোর সময় আমাকে ওরা ফুলবেলপাতা ছোঁড়ে।"  মা দুর্গা  বললেন মহাদেবকে।
মহাদেব বললেন, "গিন্নী, তোমার যাবার যে কি দরকার তাই বুঝিনা...বাপের বাড়ি, বাপের বাড়ি করে প্রতিবছর এই আদিখ্যেতা  আমারো আর পোষায়না। "
"সারাটাবছর তো এই ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে আছি আমরা। ন যজৌ, ন  তস্থৌ  অবস্থা ।  বলি তোমার অসুবিধেটা কোথায় বাপু? তোমার আফগারি বিলাসের তো ব্যবস্থা থাকছেই। আর ঐ ষাঁড় দুটো তো র‌ইলোই পাহারায়। থরে থরে সিদ্ধি-গাঁজা-আফিম-ভাঙ সব কিনেকেটে রেখে দিয়ে যাই তো।"  দুর্গা বললেন ।

এবছর সুদূর ইটালি থেকে মহাদেবের এক ভক্ত ইলারিও এলাত্‌জি  কৈলাস মানস সরোবর বেড়াতে গিয়ে মহাদেবকে একটি গন্ডোলা উপহার দিয়ে এসেছেন।  এতক্ষণ ধরে মা-বাবার কথোপকথন শুনতে পেয়ে প্রত্যুত্পন্নমতি সরো বললে
"আইডিয়া! এবার তাহলে গন্ডোলাটা আমরা কলকাতায় নিয়ে যাব। "
লক্ষ্মী বললে, "বেঁড়ে বললি বোন আমার।"
গণশা ভুঁড়ি চুলকোতে চুলকোতে শুঁড়টা দুলিয়ে সম্মতি দিল। আর কেতো সেই কথা শুনে ঘরের বাইরে পার্ক করে রাখা গন্ডোলাটিকে ঘষেমেজে সাফ করতে উঠে পড়ে লেগে গেল।  বলল, "ইয়েস! এবার আমরা আমাদের মত থিমসর্বস্ব  গমন শুরু করব কৈলাস থেকে। গন্ডোলায়  আগমন ও প্রত্যাবর্তন।    দাঁড়াও সে গন্ডোলা এখন বরফের আস্তরণে বন্দী হয়ে আছে। তাকে চেঁচে নিয়ে, রং চং করে নিয়ে তবে আমাদের যাওয়া।"
গণশা শুঁড় নাচিয়ে বিজ্ঞের মত বললে, "নীল-সাদা রং লাগাস ভাই নয়ত কলকাতায় আমাদের ল্যান্ডিংটা সুখের হবেনা। আর সরো তুই সারা রাস্তা আর যাই গান গাস না কেন পশ্চিমবাংলায় ঢুকে রোবিন্দসংগীত ধরিস বাপু।  কলা-কৃষ্টি-সঙ্গীত-বাদ্যের সার্বজনীন পীঠস্থান পশ্চিমবাংলা। "
দুর্গা সহাস্যে বললেন, "দেখো কেমন ছেলে বিইয়েছি!  লোকে সাধে আমায়  বলে রত্নগর্ভা! কিন্তু কৈলাস থেকে কলকাতা এই গন্ডোলা বয়ে নিয়ে যাবে কে?”
সরো বললে, "গুগ্‌ল ম্যাপস খুলে দেখে নিচ্ছি রুটটা। পালোয়ান সিং অসুর সামনে বসে দাঁড় বাইবে গন্ডোলার। আর মা তোমার সিংহকে বোলো তার সামনের হাতদুটো গন্ডোলার বাইরে রেখে জল কাটতে কাটতে যাবে সে । উল্টোদিকে কেতোর ময়ূরটা মুখ বের করে থাকবে। বাংলায় এমন নৌকতো ছিল আবহমান কাল ধরে।"
লক্ষ্মী বলল,”ময়ূরপঙ্খী যাকে বলে।  শুধু  রুটটা দেখেনে ভালো করে। কৈলাস টু কলকাতা। "
সরো বললে, "আমাদের গন্ডোলার নাম দেব সিংহ-ময়ূরপঙ্খী। আর বাকীরা কোথায় বসবে?”
মাদুর্গা  উল্লসিত হয়ে বললেন, "কেন অসুরের পেছনে আমি। আমার দুপাশে তোরা দুইবোন যেমন থাকিস   ।"
 কেতো  বললে, "ভালো বলেছ। আমরা দুইভাই উল্টোদিকে মুখ করে ময়ূরের দিকে বসবখন। গণশা একাই ব্যালেন্স করে দেবে তোমাদের।"
সরো বললে, "হোয়াট এবাউট ইঁদুর?”
 লক্ষ্মী বললে "আমার রাজহাঁসের আর তোর প্যাঁচার বাবা কোনো জ্বালা নেই। সুন্দর ডানা মেলে গন্ডোলার ওপর দিয়ে উড়তে উড়তে যাবে প্যাঁচা। আর রাজহাঁস জল কেটে কেটে ঠিক সাঁতরে ম্যানেজ করে দেবে।  মুশকিল হল ইঁদুরটাকে নিয়ে।  তেনার আবার সারাদিন দাঁত বেড়ে চলেছে। কিছু কাটতে না পরলে আমাদের জামাকাপড় সব যাবে ওর পেটে।" 
গণশা বললে, "বেশ, আমার ইঁদুরকে নিয়ে তোমাদের যখন এত জ্বালা...”
লক্ষ্মী বলল্ "আহা, রাগ করছিস কেন? আমার ধানের ঝাঁপি থেকে ধান ছড়িয়ে রেখে দেব গন্ডোলার মধ্যে। ও সারাটা রাস্তা খুঁটে খেতে খেতে পৌঁছে যাবে।"   

সরো বললে, "গন্ডোলায় উঠে মাঝিকে গান গাইতে হয় কিন্তু। অসুর কি ঐসব সূক্ষ্ম, রুচির অধিকারী? “
দুর্গা বললেন, "সরো, তুই বাবা ওটুকুনি ম্যানেজ করে দিস।"
"আমার রুদ্রবীণা অবসোলিট। আমাকে বেস গিটার কিনে দাও তবে। "
মা দুর্গা বললেন্, "ও সরো, খালি গলাতেই গলা ছেড়ে গান গেয়ে দে মা এবারটার মতো। কলকাতা পৌঁছে তোর বেস গিটারের অর্ডার দেব।"
"রবীন্দ্রসংগীতকে অপেরার মত গাইতে দেবে ওরা? গন্ডোলায় অপেরা সঙ্গীত কিন্তু অবশ্য‌ কর্তব্য।   ইলারিও বলে দিয়েছে বাবাকে। নয়ত গন্ডোলার ভরাডুবি। গলা ছেড়ে চীতকার করে গাইতে হবে গান। আমাদের মাঝিমল্লার প্যানপ্যানে ভাটিয়ালি গাইলে হবেনা। ইটালির লোকগীতি কি যেন নামটা তার, ভুলে গেছি।" সরো বলে
কেতো  ঝাঁ করে  সার্চ করে বলল, "বার্কারোল। "
"হ্যাঁ, আমাদের লোকগীতির সাথে আকাশপাতাল তফাত। আমায় ডুবাইলিরে, ভাসাইলিরে মার্কা গান ওরা গায়না। ওরা থাকুক ওদের বার্কারোল নিয়ে। আমরা আমাদের মত করে গাইব ব্যাস্!” সরো বললে।  
কেতো বললে, "এসব তো ঠিক আছে। কলকাতায় পোঁছে বানভাসি পথঘাটে গন্ডোলা চড়ে আমাদের হোল ব্যাটেলিয়ান যখন নামবে তখন ভীড়টা আন্দাজ করতে পারছো? প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে তখন থিমপুজোর মাতলামি, আমাদের নিয়ে হৈ চৈ ...সব মিলিয়ে আমরা ঘেঁটে ঘ।" 
 "যা বলেছিস।  এদিকে বৃষ্টি রিমঝিম, ওদিকে পুজোর থিম। এ পাড়ায় জল থৈ থৈ, ও পাড়ায় শুধু হৈ চৈ...
তারপরে তারস্বরে মাইক, ভীড়ে ছয়লাপ মোটরবাইক। কলকাতার হকারময়তা, আর হকারদের কলকাতাময়তা । তারচেয়ে বরং এই বেশ ভালো আছি আমরা। ঐ কটাদিন জমিয়ে খাই, চমরীর  দুধের মালাই। ব্রাহ্মণীহাঁসের রোষ্ট ।  এবারে পুজোয় যাওয়াটা পোস্টপন্ড কর!  লেট আস প্ল্যান ফর এ প্লেজার অটাম ট্রিপ !” লক্ষ্মী বললে চিন্তিত হয়ে 
তাহলে আমাদের গন্ডোলা প্ল্যান? মা দুর্গা কেঁদেই ফেললেন  ।
"মা তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যাব বলেছি যখন যাবই আমরা। আর গন্ডোলা চড়েই যাব।  তবে কলকাতায় নয়। এবার অন্য কোথাও। "
কেতো বললে "সেখানে শিল্পীদের খুব সম্মান বুঝলি সরো? আমাদের মত আমাঅদমী পাত্তাই পাবেনা। 
তার ওপরে এবার শুরু হয়েছে বেঙ্গল পুজো লিগ (বিপিএল) এর হুজ্জুটি । "
-সেটা আবার কি রে ? লক্ষ্মী বলল।
-শোন্‌, ইংল্যান্ডের ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ। তার নকলে আমাদের হল ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ। যার ধাক্কায় ক্রিকেট প্লেয়াররা ক্রিকেট ভুলে গিয়ে ফ্যাশন মডেল ও টেলিভিশন ষ্টার হয়ে গেল।  এখন ক্রিকেটের কাভার ড্রাইভের বদলে সেক্সি মন্দিরা বেদীর হল্টার বেশী পাত্তা পেল। কেতো বললে
-তার সাথে আমাদের কি সম্পর্ক? সরো বললে। 
-শোন্‌ তবে, বলছি। প্রিমিয়ার লিগে ক্রিকেটারদের খাতির দেখে হকিওয়ালার করল হকিলিগ, ব্যাডমিন্টনে করল ব্যাডমিনটন লিগ। এরপর পেশাদারি ফুটবল লিগ ও কাবাডি লিগও হচ্ছে।
 -কিন্তু তার সাথে শারদীয় উত্সবের কি সম্পর্ক?
-এটাও বোঝোনা? কাগজ পড়োনা ? এখন আর পুজোর প্যান্ডেলে গিয়ে হাত পা গুটিয়ে থুঁটো জগন্নাথ হয়ে পাঁচদিন অহোরাত্র বসে থাকলে চলবেনা। কমার্শিয়াল ব্রেকের ফাঁকে ফাঁকে হাত-পা ছুঁড়ে কিছু একটা তামাশা দেখাতে হবে। তবেই না দর্শকরা থুড়ি ভক্তরা আনন্দ পাবে আর পুজো এনজয় করবে। আর তবেই না প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ফুটফল হবে। তবেইনা চ্যানেলের টিআরপি বাড়বে। আর তবেইনা স্পনসররা পয়সা ঢালবে আর তবেই না উদ্যোক্তারা সেই টাকায় মোচ্ছব করবে!
-তার মানে আমরা নিছক এনটারটেনার্?
-আজ্ঞে হ্যাঁমশাই। ঠিক যেমন খেলোয়াড়দের খেলায় পারদর্শিতার চেয়ে চিত্তবিনোদন করা বেশি জরুরী তেমনি আমাদেরো জ্ঞান, বিবেক, বৈরাগ্য, ভক্তির আর কোনো প্রয়োজন নেই। ওসব এখন অবসোলিট। আম আদমিকে খুশি করো, তাহলেই  জুটে যাবে শারদশ্রী মার্কা একটা এওয়ার্ড।
-তাহলে আমাদের এখন কি করণীয় সেটা বল্‌।
-আমাদের তিন মহিলাকে বোল্ড এন্ড বিউটিফুল ড্রেস পরতে হবে।  ঐসব আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ির বেনরসী শাড়ি আর ব্লাউজ পরা চলবেনা। পারলে আইপিএলের চিয়ার লিডারদের মত উদ্ভিনযৌবনা হয়ে নাচতে ও নাচাতে হবে পাবলিককে।   কেতো আর অসুরকে চুলবুল পান্ডে মার্কা ভায়োলেন্ট নাচ নাচতে হবে ।  পারলে মহিলা কনস্টেবলকে পাঁজাকোলা করে । লক্ষ্মী বলল 
গণশা বললে, "আমি বাপু নাচাকোঁদায় নেই।"
কেতো বললে,   "ঠিক আছে, তোমাকে বীরাক্কেল  কিম্বা হাস্যকবি সম্মেলনের মত কাতুকুতু দিয়ে হাসাতে হবে। এই হল এবারের বিপিএল।"
-সো  উই আর গোয়িং। দিস পুজো গন্না বি বিপিএল ! থ্রি চিয়ার্স ফর বিপিএল! হিপ হিপ হুররে! মাদুর্গার চার ছেলেপুলে মহা আনন্দে চীত্কার করে উঠল ।

(আনন্দবাজার ইন্টারনেট-পুজো প্রস্তুতি-২০১৪ )

তুমি মিছে ভোলানাথে দূষণা মা !


এই নিয়ে বদলের বঙ্গে ভোলানাথের গুষ্টির  তৃতীয়বার  পদার্পণ । ভোলানাথের অবিশ্যি তাতে কোনো হেলদোল নেই।  মোটামুটি আগেভাগেই সস্তার টিকিট কেটে রাখা ছিল তাই এবার ওয়েটিং লিষ্ট কনফার্ম হবার পর মায়ের ছানা-পোনাদের আনলিমিটেড আনন্দে আপাতত অবগাহন । এবার একেই ডিজেল আগুণ তাতে আবার প্রত্যেকের নিজস্ব বাহন এক একটা  ! মায়ের খুব চিন্তা । সবশুদ্ধ একডজন পরিবারিক সদস্য । সিংহ তো দেখন হাসি ! কোনো বারণ শুনবেনা সে । আসা চা-ই-ই !  একে কোলকাতায় পার্কিং স্পেস নেই !  সিংহের মমতাময় মুখখানা দেখে মা যে গলে জল হয়ে যান । আর বেশি বাধা দিলে সে প্রায়ই মা'কে ইমোশানাল ব্ল্যাকমেল করে বসে ।  "সেদিন আমি না থাকলে জিততে কি করে? আমি সেদিন খ্যাঁকম্যাক করে না গর্জালে রেপিষ্ট অসুরটা তোমাকে ছেড়ে দিত বুঝি?  আর আমারো তো একটু হাওয়াবদল চাই না কি ! সেই কবে থেকে এই ঠান্ডার দেশে এয়েচি বলত ! মুখ বুঁজে পড়ে রয়েচি ! এখানে আমার না হয় কোনো সিংহীর সাথে ডেটিং না হয় মেটিং ! এখানে আমি বৃদ্ধ জরদগবের মত হয়ে গেলাম ! নিজেরা সব দুধ-ফলাহার খায় আমারো এখন সেই দশা । এট্টু বেড়াতে যাব তাতেও ট্যাক্স বসাতে হবে ?  যাওনা ঐ শহরে রাতবিরেতে ভীড়ের মাঝে তোমার ঐ ফুটফুটে সেক্সি মেয়েদুটোর ইজ্জত নিয়েও টানাটানি হয়ে যেতে পারে । তখন  তোমার ছেলেমেয়েদের ঐ পাখিগুলো  কি করে সামাল দেয় দেখব !"
 মা অগত্যা কেতোকে বলেছিলেন " নে বাবা , সিংহর টিকিটটাও কাট বাবা ! ও বান্দা নাছোড়"
 কেতো একগোছা ময়ূরের পালক নিয়ে ঝাঁটা বানাচ্ছিল । গতবার হ্যারিপটার দেখে এসে তার সাধ হয়েছিল ঝাঁটায় চড়ে সাঁ করে একবার পার্কস্ট্রীট পাড়ার আকাশে চক্কর মেরে আসবে ।  সে বললে  "মা, Chill, Chill !  আমি আজই অনলাইন টিকিট কেটে রাখছি সকলের "
গতবছর মায়ের পেয়ারের  মেয়ে সরো সব ভাইবোনেদের নামে একটা করে ক্রেডিট কার্ড করে দিয়েছে
লখ্যু তা দেখে বলেও ফেলেছে " ভরাডুবি হল মাগো, এবার বাবার আবারো বদনাম হয়ে যাবে । ক্রেডিট কার্ড হাতে পেয়ে কৈলাস থেকে কোলকাতা আসা-যাওয়ার পথে ওরা আদেখলার মত আনলিমিটেড শপিং করবে আর ক্রেডিট লিমিট ক্রস করে গেলে বাবার হাতে হাত কড়া !  একে তো ব্যাঙ্করাপ্ট বাবা তায় আবার আমরা তাকে ভাঙিয়ে খাচ্ছি"
সেই শুনে মুচকি হেসে গণশা বলেছিল "বাবা ভাঙ খান, আর আমরা ভাঙিয়ে খাই " 
সরো এবার বলেছে বাহা শাড়ী চাই-ই ।
শুনে লখ্যু বলেছে " আহা! কি এমন বাহা শাড়ি! আমি কিন্তু  ঘিচায় সঁপেছি প্রাণ ।
সরো বললে " গতবারে গিয়ে স্বর্ণযোজনা স্কিমে পোষ্টডেটেড চেক দিয়ে এয়েচি সেটা এবার উঠবে । আমি কুন্দনের একটা সেট নেব "
লখ্যু বললে "আমার ঝাঁপিটা এবার বদলাতে হবে । ম্যাগো ! সেবার রূপোর ওপর সোনার জল করিয়ে ছিলাম । আসার পথে বিষ্টি লেগে সব ধুয়ে উঠে গেল "
মা বললেন " আমি এবার আর দশহাতার ব্লাউজ পরবো না রে ! একে খরচাপাতি বেড়েছে তাতে বড্ড গরম ওখানে ।"
সেই শুনে সরো বললে " বলি আট্টা হাতে কি পরবে শুনি!মা বললেন " এবার গিয়ে একটু খোঁজ নিস না তোরা । সব মিটে গেলে কাটিয়ে আসব বাকী হাতগুনো । শুনেছি ওখানে বদ্যিরা ধন্বন্তরী । আট্টা হাতের অপারেশন করতে চারটের মোটে দাম নেবে । বাই ওয়ান, গেট ওয়ান ফ্রি । এই বাজারে এর চেয়ে আর ভালো ডিল কি হয় বল্‌"
গণশা বললে "মা গো ভাবনা কেন? আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্তছেলে , ঠিক একটা ব্যবস্থা হবেখন "
কেতো বললে "দেখো আমি কিন্তু নবমীনিশিতে তন্ত্রে আনপ্লাগড , কেউ আমাকে ডিসটার্ব করো না যেন, আগেই বলে দিলুম । 
গণশা বললে "হ্যাঁ, সে তো শরীরের যত্ন দেখেই বুঝতে পারছি "
কেতো বললে "হ্যাঁ, মায়ের  হেবি ওয়েট সন্তান তুমি, সারাদিন শর্করায় মজে আছো "
গনশা বললে "কেলিনু  দ্রাক্ষাকুঞ্জে,  ভুলি পরিবার পরিজন "
কেতো বললে "আমি সর্বদা স্টে ফ্রি, কেয়ার ফ্রি আর স্বাস্থ্যরক্ষার্থে সুগারফ্রি " 
মা বললেন "আবার শুরু করে দিলি তোরা তেঁতুল তলার বিষ্টি"
কেতো বললে " মা,  Cool! Cool ! relax! 
"ফেসবুকে শুনছিলাম পাড়ায় পাড়ায় পুজোর লড়াই শুরু হয়েচে । থিমপুজোর শুচিবায়ুতায় আম আদমীর ওষ্ঠাগত পরাণ ।   একে রাস্তার মোড়ে মোড়ে আলোর ত্রিশূল তাতে আবার চারধার নীলিমায় নীল ! বেঁড়ে হবে এবার পুজো কি বল ? তবে জিনিষের দাম যা বেড়েছে তাতে মনে হয় হিমঘরের ফলসবজী কিছু সাথে নিয়ে গেলে ভালো হয় । এত্তগুণো লোক আমরা চড়াও হব এই বাজারে.." লখ্যু বললে ।
সেই শুনে সরো বললে " তোর যত বেশি বেশি । জিনিষের দাম তো কি । বছরে একবার মোটে যাই আমরা, তাও তো নেমন্তন্ন না কল্লে কি আর যেতাম । হাতেপায়ে ধরে সেই নতুন বছরের পঞ্জিকা হাতে নিয়ে ওরা জপায় বাবাকে । আর সারাবছর মাধ্যমিকে আমার ডাক, সেনসেক্স পড়লে তোর ডাক  তার বেলা ??? বেশ করব যাব । তোমরা খরচাপাতি কম করো । সারাই করা রাস্তাগুলো খুঁড়ে বাঁশ পুঁতোনা ! থিমপুজোর ছুঁচিবাইতে মেতোনা । একটা পাড়ায় চারটে করে দলবাজির পুজো করবে আর আমাদের ফল-পাকড়ের বেলায় যত খরচা কমানো?   রাখো তোমার ফেসবুকামি " 
"ঠিক বলেচিস, এ পাড়া দেখাচ্ছে ওকে । এ বলে আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায় দ্যাখ । কেবল দেখবি আর জ্বলবি, লুচির মত ফুলবি'র পুজো এখন । যত্তসব !   গণশা বলে বসলে ।
কেতো বললে " তা যাই বলো আর তাই বলো, এবার কার্তিকে পুজোতে  ব্যাপক ওয়েদার হবে । আর আমার তো শুধু যাওয়া আর আসাই সার । গিয়েই আবার আসতে হবে ।  ঠান্ডায় খেয়ে-বেড়িয়ে, ঝাড়ি মেরে সুখ  !
হ্যাঁ, আর তন্ত্রে সুখ, মন্ত্রে সুখ ! গণশা বললে  
ওখানে গেলে ট্র্যাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে রবিঠাকুরের গান শোনা যায়। ভোরবেলায় শুনতে পাবে আজ জ্যোত্স্নারাতে সবাই গেছে বনে, দুপুরে শুনবে এদিন আজি কোন্‌ ঘরে গো খুলে দিল দ্বার, ভরাভাদরের বিকেলে শুনবে শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন আর কার্তিকের হিমঝরা রাত্তিরে শুনতে পাবে তুমি ডাক দিয়েছ কোন্‌ সকালে কেউ তা জানেনা! শিল্পীদের গায়কীতে তোমার মনপ্রাণ তখন কানায় কানায়...  সরো বললে 
তোমাদের প্রত্যেকের ছবি আর পরিচয় পত্তর চাই কিন্তু। এবারে ওটা ম্যান্ডেটরি। গণশা বললে।
কেতো বললে পাসপোর্টে তো আছেই সবকিছু। না হলে ওখানে গিয়ে নতুন সিম, তারপর সেলফি ...ক্লিক ক্লিক অর সেভ এজ...সেন্ট টু....  ওরা এখন এসবে খুব চোস্ত!
লখ্যু বললে, মানে নিজস্বী ? আর হবেনা? সারাবিশ্ব যখন কম্পু-জ্বরে কাহিল তখন ওরা রক্ত দিয়ে অটোমেশন রুখেছিল। এখন দিন বদলেছে, ওরাও বদলেছে। বুঝেছে, গতি নাই, গতি নাই, কালী মায়ের  চরণ বিনা গতি নাই, গতি নাই।   
তবে আমি কিন্তু অটোতে এবার আর উঠছিনা বস্‌! গণশা বেশ ঝেঁঝেই বললে। অটোবাবুগুলো গতবার আমার শুঁড়  ধরে এমন ঘুরিয়ে দিয়েছিল, এখনো মাঝেমাঝেই ব্যথাটা আমাকে বড্ড কষ্ট দেয়। খুচরো চাই তাদের্! আমি যত বলি আজকাল কেউ দানপত্রের বাক্সে খুচরো দেয়না, সকলে বড় নোট দেয়, আমি ভিনদেশে থাকি, কোথায় পাব খুচরো, সে কিনা আমার শুঁড়টা ধরে বলে,আগে খুচরো দাও, নয়ত ছাড়ব না...   
কেতো বললে, যেমন অটোতে ওঠা! ঠিক হয়েছে তোমার। আমি তো বাপু রেডিও ক্যাবে খুব স্বাছন্দ্য বোধ করি।
তোমার ব্যাপার স্যাপার আলাদা। তুমি হলে গিয়ে কৈলাসনগরের মাল একখানা। চাইলেই লোক   ঢুকিয়ে দিতে পারো রাতবিরেতে....  মনে করলেই ধরে আনতে পারো যাকে ইচ্ছে তাকে, কেটে কুচি কুচি করে দিতে পারো। তোমার ব্যাপারটাই আলাদা বস্‌! 
 গণেশ মশকরা করছিল খুব। এমনিতেই সে তেমনি স্বভাবের। হঠাত হঠাত ভাইবোনদের পেছনে লাগে আর মায়ের সাথে ঠাট্টা করে। বলে বসল " মা জানো এবার নাকি আমাদের সকলের গায়ের রং নারায়ণের মত নীল করলে আর নীল পোষাক পরলে প্যান্ডেলে প্রচুর প্রণামী পাওয়া যাবে। ওখানকার সরকারের হুকুম। চারিদিক নীলিমায় নীল সেখানে। নীল আকাশের নীচে এই বঙ্গ , নীলে নীল তার সাঙ্গোপাঙ্গ.... তুমি জানোনা কি!  কেতো বললে, বস্‌, কবে থেকে আমি বলছি একটা ব্লু ফেডেড জিনস পরব, তা না মা কেবল সেই আদ্যিকাল থেকে আমাকে ধুতি পরিয়ে আসছে! বাঁচা গেল, এবার তাহলে আমি ব্লু জিনস!  কিন্তু দাদা তোর কোমরের যা পরিধি তুই কিন্তু জিনস পরার চিন্তাও করিসনা। বরং নীল ডিজাইনার ধুতি পর এবছর।  
রঙীন ধুতি? এ মাগো! তাও আবার বাংলায়?
এমা জানিসনা তুই? সকলে ওখানে এখন লাল, মেরুণ ধুতি পরে আর এবারে সক্কলে নীল ধুতি পরবে। 
ওদিকে মা চেঁচিয়ে উঠলেন " শিগ্‌গির আয় তোরা, তোদের বাবা কেমন করছে ! "
ছেলেমেয়েরা বললে "  এ আর নতুন কি মা, প্রতিবারই তো আমাদের যাবার সময় এগিয়ে এলে, আকাশতলে, অনিলেজলে, দিকে দিগঞ্চলে, সকল লোকে, পুরে যখন পুজোর বাজনা বেজে ওঠে বাবা ইনসিকিয়োরিটিতে এমন করেন, তুমি চাপ নিওনা মা " 

(আটলান্টা পূজারী আয়োজিত পুজোসংখ্যা অঞ্জলি)

দুর্গা লাইভ



ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় 

এবার আমাদের পাড়ার পুজোর থিম ছিল লাইভ ঠাকুর  । আইডিয়াটা রূপাদেবীর মস্তিস্কপ্রসূত। রূপাদেবী আমাদের পাড়ার মহিলাদের প্রতিনিধি। মেয়েদের অধিকার, মেয়েদের সম্মান সবকিছু  শক্তহাতে ধরে রেখেছেন বহুদিন ধরে। এ পাড়ায় কেউ ভাবতেই পারেনা ইভটিজিং বা রেপের মত অপকম্মের কথা ।  সেই রূপাদেবী একসন্ধ্যায় পুজোর মিটিংয়ে ঠিক করলেন, এবার প্যান্ডেলে নো নাচাগানা, হাস্যকৌতুক। প্রতিদিন সন্ধ্যেয় একঘন্টা করে লাইভ শো হবে।   
পাড়ার ছেলেরা মুখ চাওয়াচাউয়ি করল বটে কিন্তু রূপাদেবীর কথার ওপর কারোর কথা টেঁকলো না। "মাই চয়েস' এর দাপট নেই তাঁর ভাষায় কিন্তু ওনার হাসিতেই সব মাত! ঠিক যেন সাক্ষাত মাদুর্গা তিনি।

 মোড়ের মাথার মিষ্টির দোকানের ময়রার বেশ মোটাসোটা নাদুস নুদুস ছেলে  গোপলা  হয়েছিল গণেশ ।  বলিউডের স্বপ্নে বিভোর, চোখে সানগ্লাস,  বাহুর পেশীতে নিকষ কালো ট্যাটু আঁকা আর দুহাতে ঝিঞ্চ্যাক রিস্টলেট পরা  হৃত্তিক হয়েছিল কার্তিক । পাড়ার ছেলেদের  হার্টথ্রব স্মার্ট ও অতিসৌম্যা অণ্বেষা  হয়েছিল সরস্বতী, কিন্ডারগার্টেনের টিচার সে ।  লক্ষ্মী সেজেছে সদাহাস্যাময়ী  টুম্পা । এনজিওতে কাজ করে  ।
আর মাদুর্গার বেশে দশাশয়ী,  লাবণ্যময়ী  রূপাদেবী । তিনি  সমাজসেবিকা, দেখতেও প্রতিমার মত ।  

সবুজসঙ্ঘ  ক্লাবে জোরকদমে অনুশীলন হল  ।  জ্যান্ত দুর্গা ও  তাঁর ব্যাটেলিয়ন পুজোর ক'দিন শুধু সেজেগুজেই বসে  ছিলনা   । রোজ রাতে  প্যান্ডেলে তাদের নিয়ে নাটকের মহড়া চলত  । মজার নাটক লিখেছে পাড়ারই ছেলে মাছওয়ালা সৌরভ । সৌরভ খুব সৃষ্টিশীল। একহাতে মাছ কাটে অন্যহাতে কবিতা লিখতে পারে। তাই তার হাতে স্ক্রিপ্ট লেখার ভার।   পল্লীরক্ষা কমিটির পান্ডা কালিপদ সেজেছিল  অসুর । ষন্ডামার্কা চেহারা, ইয়া মোটা গোঁফ, কুচকুচে কালো গায়ের রঙ তার  ।  একটু গেঁটে বাত আছে এই যা!  তাছাড়া সব ঠিকঠাক।

সপ্তমীর দিনটা...

ওদিকে মঞ্চের পেছন থেকে আওয়াজ ভেসে আসে মাদুর্গার কানে। গ্রিণরুমে সাজগোজ চলছে। আর চলছে খোশমেজাজে গল্পগাছা।

গণেশ বলছিল, কতদিন ম্যাগি খাইনা ! দোকানবাজার, শপিংমল সর্বত্র ম্যাগি হাওয়া হয়ে গেল রাতারাতি!
কার্তিক বলে, আবারো সে ফিরিয়া আসিল বলিয়া, চিন্তা নেই তোর! 
লক্ষ্মী বলছিল ক্যাশকান্ডের কথা। শুনেছিস কখনো তোরা? বাবারে, মারে! এত্তটাকা? বাবার জন্মে চোখে দেখার কথা তো ভাবিওনি আর গল্পেও পড়িনিরে! 
সরস্বতী বলল, এটাই যুগ। ঘুষ নিয়ে বড়োলোক হওয়ার রেওয়াজ চলে আসছে সেই রবার্ট ক্লাইভের আমল থেকে। এতো কোন ছার্! যাক ঘুসুড়ির ঐ ঘুষখোর আজ সেলিব্রিটি হয়ে গেল । কাগজে, টিভিতে সকলে একবাক্যে লোকটাকে চেনে। আমাকে, তোকে কি কেউ চিনবে এজন্মে?
লক্ষ্মী বলল, আমার চাইনা অমন নেগেটিভ ইমেজ। 

অসুরের সাথে কথা হচ্ছিল নাট্যকার কাম মাছব্যাবসায়ী কাম কবি সৌরভের। সৌরভ স্ক্রিপ্টের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বলছিল, গুরু, তোমার গোঁফজোড়াটা যা হয়েচে না? পুজোর পরেও কেটোনি যেন। ব্যাপক মানিয়েচে তোমার গায়ের রংয়ের সাথে। সেই লোমশমুনির মত তোমার বডি আর বাবরি বাবরি চুলগুলো যা কার্ল করেচ কত্তা !   অসুর বলে কথা! যাক্‌, একটা বিড়ি দাওনা বস্!
অসুর বলল, যা ফোট, আর বিড়ি নেই। টেনশানে সব শেষ করে ফেলেচি। এখন বাইরেও যাওয়া যাবেনি। 
ক্রুদ্ধ সৌরভ বললে, ছিলে সারদার এজেন্ট, হলে অসুর! সিবিআই জানতে পারলে নাটক করা বের করে দেবে।  কেসটা দেখেছো তো! অসুর ট্যাঁকের কোমরবন্ধ সরিয়ে তার মধ্যে থেকে একখানা চিঁড়েচ্যাপটা বিড়ি ধরিয়ে সৌরভের হাতে দিলে। আর বললে, কেন এমন করে মাঝেমাঝেই সারদার খোঁচাটা মারিস বলতো? এই সরাদার যখন রমরমা ছিল তোকে কতবার স্টেজ দিয়েছে বলতো! মঞ্চে উঠেচিস, কবিতা পড়েচিস, পয়সাও পেয়েচিস। এখন না হয় নাটকফাটক লিখচিস, আমি আলাপ না করিয়ে দিলে কে তোকে এজেন্টের কাজটা দিত বুঝি? ঐ মাছের ব্যাওসা করে কত টাকা থাকে তোর? সৌরভ বললে, থাক মামা, আমার ঘাট হয়েচে। আর পুরোণো কাসুন্দি ঘেঁটোনি। কেঁচো খুঁড়তে খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসবে। 

লাইটম্যান কল্যাণের সাথে সাউন্ডের তাপসের অহি নকুল সম্পর্ক। হঠাত মঞ্চে আলো জ্বলেই নিভে যাচ্ছে কেন? আবার ঝোলানো মাইকগুলোতে সাউন্ড এসেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কেন? আলো জ্বললে সাউন্ড নেই, সাউন্ড এলে আলো বন্ধ।  
কল্যাণ তাপসের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, রবিনসন স্ট্রীটের বাড়িতে যাওয়া আসা ছিল এনার। বাবু আবার আজ এখানে কি কঙ্কালকান্ড বানাবে দেখা যাক ।
তাপস ইলেকট্রিকের তারগুলো গোটাতে গোটাতে আড়চোখে চেয়ে বলল,  ঐসব তারগুলো বিষাক্ত হয়ে গেছে। এগুলো এখুনি পাল্টানো দরকার। যাদবপুর থেকে প্রেসিডেন্সি কোথায় না যায় তোর লাইট! সব স্টেজে আলো তোর একবগ্গা।
যাই রূপাদেবীকে বলি গিয়ে,  "ম্যাডাম !   হোক, হোক হোক কলরব!  এমন ইলেক্ট্রিকের তারে ফাংশান হবেনা। শেষে আমার সাউন্ডের বদনাম হযে যাবে '

সিংহ সাজানো হয়েচে ঐ পাড়ার একটা দোকানদারের ক্ষীণজীবি ছেলে পুঁটকে কে। তার জন্য এসেছে সিংহের পোষাক। কিন্তু সকলের খুব চিন্তা, পুঁটকে এই গরমে, অত আলোর মাঝে ঐ পোষাকটা পরে কতক্ষণ হাঁটু মুড়ে বসে থাকবে ছেলেটা  ! এত সুইট কিন্তু বড্ড ধুবলাপাতলা। রূপাদেবী ফ্লাস্কে করে গ্লুকন ডি গুলে আনেন পুঁটকের জন্যে। পুঁটকে যাতে কাহিল না হয়ে পড়ে। সকলের খুব চিন্তা তাকে নিয়ে । রূপাদেবীর পায়ের নীচে অতক্ষণ ধরে বসে থাকা কি চাড্ডিখানি কথা! 
পশুরাজবেশী পুঁটকে বলল, রূপা আন্টি ! আপনার পাদুটো বেশিক্ষণ যেন আমার পিঠের ওপর রাখবেননা। আমি তাহলে আজ রাতেই ....পুঁটকের কথা শেষ হতে না হতেই পাড়ার গৌরব হৃত্তিক বললে, আহহা! তুই একদম চিন্তা করিসনা পুঁটকে! রূপা আন্টির সব ব্যাবস্থা করা আছে। ওনার বাড়ির পোষা কুকুর, পাড়ার লেড়ি সকলের জন্যে আমাদের হাসপাতালে ডায়রিয়া টু ডায়ালিসিস সব চিকিত্সার সুবন্দোবস্ত আছে। তাই সারমেয় টু সিংহ সকলেই সেখানে রাজার হালে ট্রিটমেন্ট পাবে। আফটার অল তুই মানুষ। অতএব কোনো চিন্তা নেই তোর! 

রূপাদেবীকে একটু তোল্লাই দিয়ে  গণেশের বেশে গোপালটা পেট চুলকাতে চুলকাতে বলল, মাতৃভূমির ব্যাপার স্যাপার রাজকীয় বস্!  এমন পাড়াটি কোথাও খুঁজে পাবেনাকো তুমি!

ব্যাস্! অসুরবেশী কালীপদ গেল ক্ষেপে! মাত্তিভূমি কেন বলচিস্‌? পিত্তিভূমিও তো হতে পারে! মেয়েরা কি একা রাজত্ব করচে এদেশে? না কি মেয়েরা একা একা পারবে? বলি পুরুষ ছাড়া কোন্‌ মেয়ের জীবনটা সম্পূর্ণ হয় ....বলি এই জন্যেই তো সেদিন টেরেনে কত কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি হল, পাথর ছুঁড়ে কত কিত্তি হল  তারপরেও তোরা মাত্তিভূমি, মাত্তিভূমি বলে চেঁচাবি? ধর্‌, এই নাটকটাই রূপা ম্যাডাম কেবল দুগ্গা, সরোসতী আর লক্কি নিয়ে মঞ্চস্থ করতে পারতেন? এই নাটকে আমরা পুরুষরা দলে ভারি...হ্যাঁ, এই বলে দিলুম।


আলোয় উদ্ভাসিত সবুজসঙ্ঘের জ্যান্ত দুর্গা বাহিনী ।    

গণেশ :  এবার ক'দিন জিমে যেতেই হবে,  মিষ্টি আর ছোঁবনা। ওদিকে সুগারফ্রিতেও নাকি বিষ আছে বলছে ডাক্তারবাবুরা! 

লক্ষ্মী :  বরং একটা ট্রেডমিল সিংহের পিঠে করে নিয়ে আয় আর তোর ঐ ফালতু রেসলিউশান গুলো "মিষ্টি খাবোনা, মিষ্টি ছোঁবনা' রাখ্‌ তো !   

সরস্বতী : একটা বেস গীটার কিনতে হবে ।  রুদ্রবীণা পুরোণো । বুঝলি? আজকাল পাতি গীটারে গান করলে কেউ পাত্তাই দেয়না! শিল্পীর একটা ফাংশানে যতগুলো গান গায় তার দ্বিগুণ যান্ত্রানুষঙ্গ না থাকলে শিল্পীর গানের কোনো কদরই হয়না! 

কার্তিক  : মায়ের স্কোয়্যার, অল রাউন্ডার মেয়ে।  পড়াশোনায় ফার্স্ট, কম্পিউটারে তুখোড়, গানে সঙ্গীতরত্ন! এসবের রহস্য কি মা? কি খাওয়াও তোমার আদরের মেয়েকে চুপিচুপি?   আদর দিয়ে ছোট থেকে মাথায় তুলেছ মেয়েকে !  কম আদিখ্যেতা করলে ! আমার বেলাতেই  যত কর বসানো । নবমীতে আমি কিন্তু পার্কস্ট্রীট তন্ত্রে যাব । সেলফোন বন্ধ থাকবে ।

দুর্গা : ওরে! আমার হাতের পাঁচটা আঙুল এক। আমি মা হয়ে কখনো পক্ষপাতিত্ত্ব করতে পারি? তবে কার্তিক, বাবা তোর কাছে আমার একটাই অনুরোধ!  তোদের  বাপের একপয়সা রোজগারের মুরদ নেই আর ছেলেমেয়েরা ফূর্তি করে  ভাঙিয়ে খেয়ে শেষ করলে বড্ড খারাপ লাগে। 

গণেশ : বাবা ভাঙ খান, আমরা ভাঙিয়ে খাই । এ আর নতুন কি মা? 

দুর্গা : তোরা  বিয়েটিয়ে করে আমাকে একটু শান্তি দিবি ? স্থায়ী একটা সংসার পাতবি ? আমাকে দেখ  ! ঐ পাগলছাগল  নিয়ে, ওর নেশাটেশা  মেনে নিয়ে আজীবন কাটিয়ে দিলাম

লক্ষ্মী :  বিয়ে করে সংসার পাতলেই  মোক্ষলাভ  ?  কৈলাসে বেম্মা, বিষ্ণু, বাবার আওতায়  থাকলে কিস্যুটি হবেনা ।  পাততাড়ি গোটাতে হবে । বদলের বঙ্গে সব দেখেশুনে আসব । এখন বিয়ে অবসোলিট। লিভ-ইন করব আমরা । 

সরস্বতী  :   একদম ঠিক বলেচিস। লিভ-টুগেদার ইজ  বেটার দ্যান ম্যারেজ। বাই দ্যা ওয়ে  মা, এই গরমে ওখানে এবার আর সিল্কের শাড়ি পরবনা কিন্তু ।   ঢাকাই মসলিন  হালকা  আর বাংলায় গিয়ে  ঢাকাই  না পরলে ইজ্জত থাকেনা । একে তো বাবা চাকরীবাকরী করেনা, নেশাটেশা করে বলে মামারবাড়ির সকলে আমাদের একটু হেয় করে ।

 দুর্গা : ভাবছি এবার দশহাতার ব্লাউজ করাব না । স্পন্ডোলিসিসের  কারণে  পিঠের  ব্যাথাটা যা বেড়েছে অতগুলো হাতা পরতে বড্ড কষ্ট হয় ।

অসুরের বেশে কালীপদ ব্যথার কথা শুনে চীত্কার করে বলে উঠল,  "মা গো  ! আজ এক টিউব ভোলিনি দিতে ভুলোনি মাগো!  এবার ক্ষান্ত দাও, তোমার পায়ের নীচে বসে বসে আমার কোমরে মস্ত ফিক লেগে গেছে '

মঞ্চের আলো নিভল। হাসিতে ফেটে পড়ল দর্শককুল। স্ক্রিপ্ট রাইটার সৌরভ আড়াল থেকে প্রম্পট করছিল। সে তো হেসেই খুন। সে গ্রিণরুমের দিকে যেতেই দেখা হল জ্যান্ত দুর্গাবাহিনীর সকলের সাথে।  প্রথমেই তার করমর্দণ হল কালীপদর সাথে... "ফাটিয়ে দিয়েছো গুরু! কালীপদদা! এবার বঙ্গভূষণটা তোমার কপালেই!  '
অসুরবেশী কালীপদ বলল, "কেউ বুঝতে পারেনি তো ? '
সৌরভ বলল, "আরে নাহ্! ঐ ভীড়ের মধ্যে কে বুঝবে? তোমার ডায়লগটা তো এত প্রাণবন্ত ছিল! আমি ধরতে পারিনি তো ওরা কোন ছার! '
সমাজসেবিকা রূপাদেবী দুর্গার বেশ পরেই গ্রিণরুমে গিয়ে ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে একটা একশোটাকার নোট বের করে সৌরভের হাতে দিয়ে বললেন' একটা ভোলিনি স্প্রে এনে দে এক্ষুণি, নয়তো আধঘন্টা বাদে পরের লাইভ শো'টা ক্যাচাল হয়ে যাবে কালীপদর জন্য।  এখনো বাকী আছে তিনদিন। আজ তো মোটে সপ্তমী!

আমেরিকা থেকে প্রকাশিত ম্যাগাজিন "দুকুল" অক্টোবর ২০১৫

Sunday, June 28, 2015

বাঁশে তেলে

যাদব চকোত্তির পাটীগণিত ব‌ইয়ের বাঁদরের সেই বিখ্যাত অঙ্ক মনে পড়ে ? বাঁশের গায়ে তেল মাখানো, বাঁদর কিছুটা ওঠে তো কিছুটা নামে.. এই আমার মত অনামা লেখকের মত । একটু উঠলেই মনে হয় অনেকটা পথ গেলাম । পরক্ষণেই সম্পাদকের অপছন্দের মেল আসে উড়ে। আবার নামো ঐ বাঁদরের মত। চিরটাকাল ঐ অঙ্কটাকে ভয় পেয়ে গেলাম আর সেই অঙ্ক‌ই আমায় তাড়িয়ে নিয়ে চলল সারাটা জীবন ধরে। আমার মা বলতেন সংসারে যে সহে, সে রহে, সারদামায়ের কথা। সেই আপ্তবাক্য মাথায় করেই চলি। তবে বাঁদর হতে চাইনে। স্বামী বলেন বাঁদর আর খারাপ কি হল? রামচন্দ্রের সেতু বাঁধার সময় কত কত বাঁদর তাঁকে সাহায্য করে ফেমাস হয়ে গেল। তুমিও তো বাঁদর হয়ে সেলেব হতে পারো। শ্বশুরবাড়িতেও সেই এক টানা আর পোড়েন। আমার দিন যাপনের চিত্রটা সেই বাঁদরের মত‌ই থেকে গেল শয়নে, স্বপনে, জাগরণে। একহাতে ঝিনুকবাটি অন্যহাতে দাঁতকপাটি। সকলের মন জুগিয়ে চলো। তরতর করে পার হবে বৈতরণীর ঢেউ। একটু তেল কম পড়েছে তো ব্যাস্! পা স্লিপ করে নামো সেই সাপলুডোর নিরানব্ব‌ইয়ের ঘর থেকে সজোরে শূন্যোয়। আপাতভাবে মনে হচ্ছে তো ? যে তেল কম পড়লে স্লিপ করবে কেন? তেল বেশী দিলেই তো স্লিপ করে পড়ার কথা। কিন্তু না, সংসারে তা হয়না বন্ধু। তেল কম পড়লেই পা স্লিপ করে। তাই গরগরে কালিয়া কিম্বা তেলে চুপচুপে বেগুনীর মত করে তেল ঢেলে যেতেই হয় এখানে, অহোরাত্র। আরে মশাই সংসারটাও তো রাজনীতির জায়গা না কি! স্বামী এদ্দিন বাদে বললেন ফিসফিস করে। বাড়ির ভেতরে চাপা চাপা রাজনীতি। বাম আছে, ডান আছে। কৌরব আছে, পান্ডব‌ও আছে। লুডোর চালটা তোমার হাতে। সেখানে মন্থরা আছে, কৈকেয়ী আছে। শকুনিও আছে রিভেঞ্জ নেওয়ার জন্যে। তোমাকে এত্তগুলো প্যারামিটার কব্জা করে একহাতে বাঁশ ধরতে হবে শক্ত করে আর অন্য হাতে নিতে হবে তেলের বাটি। সব তেল চলবেনা। একটু দামী তেল নিতে হবে মানে অলিভ অয়েল হলেই বেষ্ট। কোলাপ্সিবল গেটের না হয় কঠিন হৃদয়, পোড়া মোবিলেও মন ভেজে তার কিন্তু মানুষ যে বাঁদরের উত্তরপুরুষ তার তো চাই খাঁটি তেল। অবশেষে একস্ট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল নিয়ে এলাম। হাজার টাকা কিলো বলে কতা! সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবেনা। সকলের হৃদয়ের খেয়ালও হল, আবার আমার বাঁশটা একটু বেশিই তৈলাক্ত হল। অতএব এগোও চটপট। কৌরবপক্ষ আপাতত মুখে কুলুপ। হঠাত একদিন দুপুরে তাদের ইচ্ছে হল অপন্না সেনের "গয়নার বাস্ক" খুলে দেখার । বুক মাই শো! বাড়ির নাকের ডগায় সিনেমা! কত যত্ন করে, নো রিফিউসাল ট্যাক্সি করে সিনেমায় নিয়ে গেনু, হাফটাইমে চিপ্স-পপকর্ণ খাওয়ানু, বেরিয়ে এসে এগ-চিকেন রোল অর্ডার দিনু! পরদিন লেডিজ পার্কে হাঁটতে গিয়ে ফিরে এসে শাউড়িটা কি নেমোখারামি কল্লে! বলে কিনা তার বান্ধবীরা মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখতে গেচে, পিত্জা খেয়েচে আরো কত কি! মানে আমার সব তেল জ্বলে শেষ এক নিমেষে! বুঝলাম আরো তেল চাই নয়ত আমার বাঁশ আর আমাকে নিয়ে যাবেনা একটুও। আর আমার ঐ জা'টা সে কেবলি কুমন্ত্রণা দেয় কানে কানে! বলে যেমন আপনি আদিখ্যেতা করেন আপনার ছোটোবৌমাকে নিয়ে! সেবার সাধে দিয়ে দিলেন সলিড সোনার ধেড়ি ঝুম্কো, আর আমার বেলায় ঝুটো পাথরের দুল ! গয়নার বাস্ক দেখে এসে ওবধি বুড়িটা খুব হুঁশিয়ার হয়েচে, বলে আর আঁচলের চাবির গোচা ভুলেও তোমাদের কাচে নয়! নাহ্! বিশ্বাস নেই! আমার জা যখন যেমন তখন তেমন, যেখানে যেমন, সেখানে তেমন। সাপের গালেও হামি খায় , ব্যাঙের জিভেও জিভ ঠেকায়। চোর কে বলে চুরি করতে আর গেরস্তকে বলে সাবধান হতে। প্রথম প্রথম বুঝতামনা। আমাকে সিনেমা দেখাচ্ছে, কবিরাজী কাটলেট খাওয়াচ্ছে আবার আমার বাপেরবাড়ি যাত্রায় আল্হাদে আটখানি হয়ে আমার শাশুড়ি মা'কে বিলাতি আইসক্রিম খাওয়াচ্ছে। বাসকিন রবিনস খেয়ে তেনার কি আনন্দ ! এসেই দেখি পার্টিতে দিদিভাইয়ের গলায় তেনার জাল-ফাঁশ হারখানা। মনে মনে বলে উঠি "এ মনিহার আমার গলে নাহি সাজে দিদিভাই" তুমি জালি করো আর আমায় ফাঁসিয়ে দিতে ওস্তাদ এক মহিলা অতএব "বধু ধরো ধরো মালা পরো গলে!" কাজের লোক না এলে রান্নাবাড়ি, ঝাড়াপোঁচা, বাসন-কাপড় সব আমার ভাগে। কেন না বড় বৌমা ইস্কুলের দিদিমণি। মাস গেলে চাঁদির জুতোর তৈলাক্ত শুকতলা দিয়ে তেনার জন্যে পয়লা বোশেখে স্লিভলেস হাউসকোট, বলরামের সুগারফ্রি মিষ্টি, মনজিনিসের মনের মত জিনিষ, তেনাদের শোবার ঘরের লেসের পর্দার কাপড়, পুজোর সময় জরিপাড় সাউথ কটন আসে। না হয় সেগুলো আমার অলিভ অয়েলের চেয়েও ঢের দামী তাই বলে ওনাকে একটু রান্নাঘরে যেতে বললেই বলেন সংসার আমার নয়, তোমাদের। বাড়ি আমার। বোঝো ঠ্যালা! আরে ভাই এতো সেই মুকুল মার্কা কতা হল! আমি সরকারের কেউ ন‌ই। আমি দলের । অবশেষে বাঁশ আবার ছুলতে বসি। আরো মসৃণ হবে পথ। মাখাই হরেক কিসিমের ঘি, মাখন, রিফাইন্ড অয়েল। তবুও সুযোগ পেলেই বুড়িটা বাঁশ দেয় আমাকে। যাকে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা। ওনার বাঁশটা ইসপেশাল বাঁশ, মানে ইংরেজীতে যাকে বলে "বাম্বু" । অদৃশ্য বাম্বু। ওনার মাথার বাঁদিকের কোনো এক চোরাকুঠুরিতে রাখা থাকে। আর পারলে উনি না ছুলেই প্রয়োগ করেন সেটি, কখনো আমার ওপর কখনো বুড়ো শ্বশুরটার ওপর, অথবা আমার একমাত্র গৃহপালিত স্বামীটির ওপর। একদিন হয়েচে কি আমার উনি ওনার উনিকে চুপিচুপি বলচেন, বাবা, চলো আমরা একদিন সকলে মিলে হোটেলে খাই। উনি শুনতে পেয়েই বললেন, "ঐ দ্যাকো, আবারো তেল দিচ্ছে আমাদের গো! ঐ যে পরের মাসে তোমার কিষাণ বিকাশটা ম্যাচিওর করচে, ঠিক খেয়াল আছে ওদের। উড়োজাহাজের মত বুদ্ধিটা বোধহয় বৌয়ের। মাগের ভেড়ো তো একটা। উঠচে আর বসচে ঐ মেয়েটার কতায়!” আমি পর্দার আড়াল থেকে একগাল হেসে বলি "উড়োজাহাজ না রকেট" । ঠিক অশ্বত্থামা হত ইতি গজর মত মৃদু স্বরে। কারণ তিনি শুনতে পেলেই ব্যস্! গুষ্টির তুষ্টি করে আমার ফষ্টিনষ্টি মাঠে মেরে দেবেন। বোঝো কান্ডটা! আমি হতভাগী জানিওনা ওনাদের কিষাণ বিকাশ আচে না ম্যাচিওর করচে! স্বামীকে বল্লুম, এমন করে আর থাকা যাচ্ছেনা, চলো আমরা অন্য কোথাও চলে যাই। শাউড়ি শুনলে আবারো বাণ মারবে আমাকে। এবার আমি রেডি হলুম মনে মনে। উনি বাণ মারলেই আমি যা মুখে আসবে তাই বলব। আবার ভাবছি বাঁশ দিতে গিয়ে বনফুলের "পোড়ার মুখী"র মত উল্টে আমার চোয়াল আটকে যাবেনা তো! বিয়ের পরদিন ঘোমটাটা এট্টু সরিয়েচি, ব্যাস্! উনি ক্ষেপে ব্যোম্‌ ! আর এখন নিজে স্লিভলেস নাইটি পরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে ওপারের ফ্ল্যাটের মাসীমার সঙ্গে সিরিয়ালের কতো গপ্পো কচ্চেন? সেই সাথে আমাকে বাঁশ দেবার কৌশলটাও ঝালিয়ে নিচ্চেন। ঘরে এসেই ঐ মাসীমার ছেলে-বৌ তাদের কত সুখে রেখেচে তার ফিরিস্তি। মানে তেলও চাই আবার বাঁশ দেওয়াও চাই। ভুলি নাই ভুলি নাই সেদিনের কথা। একদিন দিদিভাই মানে আমার জা স্কুল থেকে আসতেই তাকে বললাম ব্যাপারটা। সে বলল, "ভালো তো আরো তেল মাখা, আরো ক্রেডিট নিতে যা, তোর বরাতে এমনি জুটবে। তুই কি ভাবছিস, এ সংসার রাজনীতির খেল? যে তেল মাখালো সে টেন্ডার পেল, আর কংক্রিটের জঙ্গল বানিয়ে পয়সা কামিয়ে নিল? মোটেও নয়, এখানে আছে সূক্ষাতিসূক্ষ সম্পর্কের টানাপোড়েন, বুঝলি। তুই যখন শাউড়ি হবি তখন তোর বৌও এক হাত মে তেল কা শিশি আর অন্যহাত মে বাঁশ নিয়ে খেলবে তোর সাথে। মেনোপজ বুঝলি না ? মেনোপজ হল যত্ত নষ্টের কারণ। উনি এখন টোট্যালি পজড আর তুই-আমি এপ্রোচিং । বুড়োটাও খিটখিটে, বুড়িটাও তাই। তেল দিলেও কোনো লাভ নেই। পারলে জাপানী তেল নিয়ে আয়। বুড়োটাকে গিফ্ট কর। বুড়োটা সোজা থাকলে বুড়িও আরাম পাবে। আর বুড়ি আরাম পেলে আর আমাদের পেছনে লাগবেনা, বুঝলি? “ কিন্তু সেদিন যে বুড়ি বলছিল, একটা বয়েসের পর স্বামী-স্ত্রী ভাই-বোনের মত বাস করবে, ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলে গেছেন। আরে ঐ জন্যেই তো বলচি তোকে, "সব কিছুর মূলে ঐ জাপানী তেলের খেল! মনে নেই সেই গ্রাইপ ওয়াটারের এডটা? বংশ পরম্পরায় চলতেই থাকে সদ্যোজাতের পেটব্যাথা আর তখন একমাত্র সুরাহা গ্রাইপ ওয়াটারে। আর তাহলেই দেখবি অচিরেই বুড়িটার সেই অদৃশ্য বাঁশটার ডগাটা ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে, মসৃণ থেকে মসৃণতর থেকে মসৃণতমের দিকে এগুচ্ছে। " সবশেষে বলি রান্নাঘরের রসনার তৃপ্তিও কিন্তু তেলে। বাংলার অন্যতম তেলেভাজা শিল্প থেকে শুরু করে তেল কৈ অথবা পাবদামাছের তেলঝাল এ সবের মূলে তেল। আর ঐ যে সব শিল্পকর্ম, অনুষ্ঠানের মঞ্চবাঁধা থেকে শুরু করে উঁচুবাড়ির ভারা বাঁধা কিম্বা কয়লার আঁচে পোড়ানো ম্যারিনেটেড মুরগীর টুকরোকে বাঁশের মধ্যে পুরে বাম্বুচিকেন??? এসবের মূলে কিন্তু বাঁশ। অতএব বাঁশ ও তেল এ দুয়ের সহাবস্থানে জীবন চলছে চলুক। যদি জীবন চায় আরো বেশিকিছু বাড়িয়ে কমিয়ে নিন না বাঁশের সাইজ ও তেলের পরিমাণ!!! যাক্‌ আর তেলা মাথায় তেল দিলাম না। বড্ড তেলতেলে হয়ে যাবে । তেলেভাজা শিল্প হয়ে আসুক সিঙ্গুরের শিল্পমাঠে। আর বাঁশ শিল্প হোক বাঙ্গালীর নন্দনে-বন্দনে। বাঁশের ফুলদানী, ল্যাম্পশেড নন্দিত হোক মেলাপ্রাঙ্গণে। বাঁশ আর তেলের জয় হোক! জয় বংশদন্ডের জয়! জয় তৈলশিল্পের জয়!

উত্তরবঙ্গ সংবাদ রবিবার  

হায়রে ! হিপোক্রেসী।

ঠাকুর রামকৃষ্ণ নাকি প্রায়শ‌ই বলতেন! দুস্‌ শালা! উনি বললে সাতখুন মাপ আর ছেলের সামনে ভুল করে "শালা" বলে ফেললেই ব্যাস্! সংসার রসাতলে। চায়ের দোকানের ভোরের আড্ডায় প্রবেশ করেই ভুতুবাবুর চোখ কপালে! দোকানের মালিক তখনো চা চাপায়নি। ভুতুবাবু বলে উঠলেন খচ্চরটা আজ দেরী করিয়েই ছাড়বে। দোকানের মালিক পটল বললে, ভুতোদা রাগ করছেন কেন? সক্কালবেলা গালাগালি না দিলেই নয়? ভুতুবাবু বললেন, শালা ! তোমার দোকানে চা খাওয়া বন্ধ করতেই হবে দেখছি। টিঙ্কুর মা আড়ালে কাজের লোককে ঝি-মাগি বলে। টিঙ্কু বোঝেনা তার মানে। একদিন সেই ঝি-মাগিটির সামনেই টিঙ্কু ফোনে বলে বসল, মা এখন ঝি-মাগীর সাথে রান্নাঘরে কাজ করছে। তারপর সেই ঝি-মাগিটি চলে গেলে টিঙ্কুর মা তো তাকে মেরেই ফেলে আর কি! শাশুড়ি বৌমাটিকে বলে মাথায় কাপড় দিতে আবার নিজে নাইটি পরিহিতা হয়ে বেডরুম থেকে সানন্দে লিভিং রুমে অবতীর্ণ হন একপাল জনতার সামনে। ছেলের ওপর বৌয়ের দখলদারির তীব্রতা প্রমাণ করতে মা ছেলেকে আখ্যা দিলেন "মাগের ভেড়ো" । সেই শুনে ছেলেও রেগে উত্তেজিত হয়ে মা'কে জবাব দিল "এ আর নতুন কথা কি! বাপ্‌ কা বেটা, বুঝলেনা? ঠাকুমা বাবাকে বলত "স্ত্রৈণ" মা বলল "চো‌ওপ্" !!! এভাবেই জল গড়িয়ে চলেছে ভারতবর্ষে। যার বাহুমূলে যত জোর, গালাগালি তার! রাজা শশাঙ্কের আমলে মাত্সন্যায় ছিল। এখনো সেই ট্র্যাডিশন চলে আসছে। সবল দুর্বলের ওপর অত্যাচার করবে এটাই তো স্বাভাবিক। সে ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ হোক, শ্বশুরবাড়ি হোক কিম্বা রাজনীতির আঙিনা। আধ্যাত্মিক কুশীলবেরাও কত ভুল করেন ভারতবর্ষের "ধার্মিক" প্রেক্ষাপটে। কিন্তু তেনারা হলেন রাজারাজড়া, দেবতার জাত। অতএব কিং ক্যান ডু নো রং ! ঠিক ঐ গালাগালি দেবার মত। আমরা, ধর্মভীরু ভারতবাসী যুগ যুগ ধরে চোখ বুঁজে ফুল ছুঁড়ে আসছি তাদের পায়ে । আসলে আমরা হনু হিপোক্রিট। হিপোক্রেসি আমাদের মজ্জাগত। দেবদেবী থেকে শুরু করে আমজনতা সকলেই যেন এক রকম। চৈত্রমাস নাকি মধুমাস। কারণ রামায়ণের হিরো রামের জন্মমাস। শুক্লা চৈত্রনবমীতে রামচন্দ্রের জন্মদিন। যে মানুষটা গণতান্ত্রিক স্বার্থে বৌকে ত্যাগ দিয়েছিল ? রাবণের ঘরে সীতার দিনযাপনকে কলঙ্কিত করে সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে বাধ্য করেছিল তার জন্য ঘটা করে জন্মদিন? মানতে বড় কষ্ট হয়। আদর্শবান পুরুষচরিত্র হয়েও সীতার দুঃখ বুঝতে পারেনি সে হেন পুরুষনায়কের জন্য ছেলের মায়েরা রামনবমীর উপবাস করেন। ভাবতে কষ্ট হয়। মনে মনে বলি, রামের চৈত্রমাস, সীতার সর্বনাশ। কৈ সীতার আত্মত্যাগের জন্য কেউ তো সীতার জন্মদিন পালন করেনা? রামকে নিয়ে কত ভজন গান হয়। কিন্তু সীতার জন্য ক'জন ভজন গান? এমনকি "পঞ্চকন্যা"... অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তী, তারা ও মন্দোদরীর সাথে এক আসনেও সীতা স্মরেণ্যা ও বরেণ্যা নন। রাম নাকি দ্বাপরে কৃষ্ণের অবতার। তাই তার সাতখুন মাপ? এই রাম রাবণকে যুদ্ধে হারিয়ে বধ করবে বলে ধনুকভাঙা পণ করেছিল। মা দুর্গার স্তব করেছিল। আর শরতকালে দুর্গাপুজো করবে বলে দেবতাদের ঘুম পর্যন্ত ভাঙিয়েছিল অকালবোধন করে। রাম ঘরের সম্মান রাখতে পারলনা অথচ নিজের স্বার্থে দুর্গা নামে আরেক শক্তিশালী নারীর পুজো করতেও পিছপা হলনা! হায়রে! হিপোক্রেসি ভারতের ধর্মের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নিজের প্রয়োজনে এক নারীর পায়ে একশো আট পদ্ম দিয়ে পুজো হল অথচ রাবণ বধ করে সীতাকে লাভ করে অন্যের কথায় বৌকে ত্যাগ দিল! সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে বাল্মীকির আশ্রমে পাঠাতে যার একটুও বুক কাঁপলনা ! এ হেন রামের অয়ন অর্থাত গমন পথকে কেন্দ্র করেই রচিত হয়েছিল আমাদের মহাকাব্য রামায়ণ। কিন্তু সীতার পাতাল প্রবেশ কিম্বা অগ্নিপরীক্ষা কি তাকে মনে রাখেনা? সীতা মাটির কন্যা আবার মাটিতেই মিশে গেছিলেন। তাই সীতায়ণ বা সীতার গমন পথও তো হতে পারত এই মহাকাব্যের নাম। মাটির কন্যা সীতা লাঙ্গলের ফলা বা "সীত" থেকে উঠে এসেছিলেন। আবার অত্যাচারে, লাঞ্ছনায় অতিষ্ঠ হয়ে বসুন্ধরার কোলেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাই নিজের জীবনচক্র তো নিজেই সমাপ্ত করলেন। রামকে এত প্যাম্পার করে, আদর্শের মুন্ডপাত করে হোক না সীতায়ণ!!! মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণও কিন্তু ব্যতিক্রম নয় । কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পান্ডবদের জেতানোর জন্য তিনি অনেক কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। জারসন্ধ হত্যার জন্য ভীমকে ইঙ্গিত করা থেকে জয়দ্রথকে মারার চক্রান্ত করে আচমকা যুদ্ধক্ষেত্রে আঁধার ঘনিয়ে এনেছিলেন। তিথি নক্ষত্র না মেনেও সূর্যগ্রহণ ঘোষিত হয়েছিল। আমাদের কাছে শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু পুরুষোত্তম। টেলিভিশন খুললেই এখন বিদ্যা বালনের সেই মুখঝামটা? কনে বৌটির ছাতনাতলাতে মাথার কাপড় এক মুহূর্তের জন্য সরলেই ব্যস্! অথচ সেই গেঁয়ো কনে বৌ বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির বাইরে খোলামেলা লোকালয়ে যাবে শৌচকর্ম করতে! তার বেলা? হাইট অফ হিপোক্রেসি ! এভাবেই ভারতবর্ষ বেঁচে থেকে গেল রাম-সীতার আদর্শ আঁকড়ে, শ্রীকৃষ্ণের পরকীয়াকে ভীষণ ধর্ম, ধর্ম বলে। ধর্মের অনুশাসন বলছে "ডু হোয়াট আই সে, ডোন্ট ডু হোয়াট আই ডু"। অতএব ভীতু ভারতীয় মেনে নিল মুখ বন্ধ করে। বাড়িতে কন্যাসন্তানের জন্মের খবরটি সুসংবাদ বলে বিবেচিত হয়না আজো। পুত্রসন্তান হবার খবর এলে শাঁখ বাজিয়ে প্রচার করা হয় সেই শুভবার্তাটি। সেই কন্যারত্ন যখন দেবী লক্ষ্মী, সরস্বতী, কালী বা দুর্গা তখন কিন্তু মহাসমারোহে শঙ্খধ্বনিতে তাকে বরণ করা হয়। আজো গ্রামে গঞ্জে পুত্রসন্তানের অন্নপ্রাশনে ঘটা হয় কিন্তু কন্যাসন্তানকে কোনোক্রমে ঠাকুরবাড়ির প্রসাদান্ন মুখে দেওয়া হয় মুখেভাতের নিয়মরক্ষা করে। পুত্রসন্তানের জন্মদিনে পায়েসের বাটি-মাছের মুড়ো ঘটা করে তোলা হয়। আর মেয়েসন্তান বুঝি ইতুপুজোর ব্রতদাসী উমনো-ঝুমনোর মত দুর্ভাগা। গরীব বামুন বাপ তাদের পিঠে খেতে দেয়নি। বামনী যখন পিঠে ভাজছিল গন্ধ পেয়ে মেয়েদুটোর চোঁয়াপোড়া, কাঁচা-খরা পিঠে খাবার নোলায় দেওয়া হয়েছিল বনবাস স্বরূপ চরম ছ্যাঁকা । আবার সেই উমনোঝুমনো যখন ইতুদেবীর পুজো করে রাজরাণী হল তখন তাদের গরীব বাপ যেন তাদের পায়ে ধরে! কারণ তারা তখন বিত্তবান কন্যা, রাজার ঘরণী, বামুন বাপের মুখ উজ্জ্বলকারী কন্যাশ্রী। বাপ পারলে তখন মেয়েদের পুজো করে! আবারো এসে যায় জনস্বার্থে প্রচারিত বিদ্যাবালনের সেই বিজ্ঞাপনটি। প্রিয়ঙ্কা ভারতী নামে গ্রামের মেয়েটি তার স্বামীকে বলে কয়ে শৌচাগার বানায়। প্রিয়ঙ্কা এখন গাঁয়ের হিরোইন । বিয়ের রাতেই বেড়াল মেরেছে সে। শ্বশুরবাড়িতে পা দিয়েই নতুন বৌ শান্তশিষ্ট স্বামী নামক গৃহপালিত জীবটিকে বশ করেছে দেখে তার শাশুড়িটির কি জ্বলুনি ভাবুনতো! টেলিভিশনে সেই কীর্তি দেখে জনৈক শহুরে শ্বশ্রূমাতা বললেন "ছিঃ, ছিঃ, বশীকরণ জানে মেয়েটা। আর বরটাও henpecked!থাকিস তো গাঁয়ে, বনেবাদাড়ে পটি করগে যা, তাই বলে বিয়ের রাতেই বরকে বশ করা!" আসলে শ্বশ্রুমাতাটি এতসব শোনাচ্ছিলেন তাঁর নবপরিণীতা বৌমাটিকে। পাছে তার ছেলেটি হাতছাড়া হয়ে না যায়। তাই বলে খোলা স্থানে শৌচকর্মের সাথেও নো কম্প্রোমাইজ।

উত্তরবঙ্গ সংবাদ রবিবার  

Monday, June 8, 2015

সিনান যাত্রা

 সিনান যাত্রা 

জগাদার ঘরের পাশেই বিমলিপিসির ঘর। একটু আড়ালে, একটু আবডালে।  খিড়কির দোর খুলে অবাধ যাতায়াত, অনায়াস গল্পগাছা, ফষ্টিনষ্টি  । সারাদিন জগাদার শৃঙ্গার, ভৃঙ্গার, ছাপ্পান্ন ভোগের  হুজ্জুতিতে বিমলিপিসির সাথে দেখা করার ফুরসতটুকুনি হয়না। 

বিমলি পিসি বলে বলে থকে গেল। চান করাতে পারবেনা তাকে। সেই সাথে তার ভাইবোনেদেরো। চান করতে বললে জগাদা রেগে আগুণ, তেলে বেগুণ।  এদিকে রোজ রাতেরবেলায় খিড়কির দোর খুলে বিমলিপিসির একটিবার না দেখা হলেও নয়। জগাদার ঘুম আসেনা। বিমলিপিসিও ছটফট করতে থাকেন। উড়িষ্যার ঐ প্রচন্ড দাবদাহে দিনের পর দিন, ঘন্টার পর ঘন্টা   জগাদা স্নান না করে গু-শুকনি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন লাঠিসোঁটা নিয়ে। শীতকালে না হয় রোজ স্নান না করলেও চলে। তারপর চৈত্র গিয়ে বোশেখ এলে জোর করে তাকে চন্দন যাত্রায় পাঠানো হয়। আবার একমাসের মধ্যেই প্রচন্ড গরমে হাঁসফাঁস। বিমলিপিসির মন মানেনা।

 রোজ রাতে বলেন
"শোনো নাগর, স্নান না করে আমার কাছে এলে গায়ে হাত দিতে দেবোনা, বলে দিলাম, অতএব পোস্কার ঝোষ্কার হয়ে এসো বাপু! একেই সারাদিনে শরীরে পচা জবাফুলের গন্ধে আমার ত্রাহি ত্রাহি ডাক। তারপর সিঁদুরের ঠেলায়, তেলে, জলে আমার শরীরটা শেষ। মেয়েরা আজকাল নিজেদের মাথায় সিঁদুর দেবেনা আর আমাকে পারলে সিঁদুরে চুবিয়ে রাখবে। সেই সাথে বেলপাতা, পদ্ম...ভক্তদের আদিখ্যেতায় আমি মরি আর কি!”

 সারাদিনের এই অত্যাচারের পর তিনি আসবেন চান না করে। এসেইমা বিমলা ওরফে আমাদের বিমলিপিসিকে  জড়িয়ে ধরবেন। সেই পেঁড়া-গুঁজিয়ার মুখেই চকাস চকাস করে পটাপট চুমু খাবেন।  কি দুর্গন্ধ মুখে! সেই কোন সকালে একবার নিমের দাঁতন বুলিয়ে নিয়েছেন দাঁতে। না টুথপেষ্ট না মাউথওয়াশ। আর সারাদিন ধরে চলছে তার ছাপ্পান্ন রকমের মিষ্টি গেলা।

"আমার  হাতদুটোতো নেই, জানো বিমলা। আমি তো ঠুঁটো হয়েই রয়ে গেলাম। একটু তাই আমার মুখ সর্বস্ব চেহারাটা দিয়েই না হয় তোমাকে সারাদিনের শেষে পেতে চাই। তাতে এত কথা? ঠিক আছে যাও, কাল থেকে আর রাতে আসব না তোমার সাথে দেখা করতে।" জগাদা বলল 
বিমলা বলে, "আহা, রাগ কচ্চো কেন নাগর? আমি কি আসতে বারণ করলাম? আমি তো তোমাকে একটু  স্নান করে আসতে বলছি শুধু! আমার যে এই গরমে বড্ড ঘেন্না করে। তুমি তো জানো সারাদিন আমিও অপেক্ষা করে থাকি এই রাতটুকুর জন্যে, উড়িষ্যায় একেই গরম আর এখানেই তুমি সহজসঙ্গী, আমার প্রাণের ভৈরব "  
"ঠিক আছে, কথা দিলাম বিমলা, ভৈরবী আমার। এবার থেকে স্নান না করে তোমার কাছে আর আসব না "

বিমলা একগাল হেসে নাকে গামছা   বেঁধে বললেন, "একটু তফাতে যাও। আগে স্নান করো, তারপর কাছে আসবে।"
জগাদা ঘষ্টে ঘষ্টে সরে গিয়ে দাঁড়ালেন, একটু মনক্ষুণ্ণ হলেনো বটে! 

"মনে আছে মিন্‌সে? জৈষ্ঠ্যমাসের পূর্ণিমা আসছে, তোমার হ্যাপি বার্থডে"  বিমলিপিসি বললেন কিঞ্চিত ধমকের সুরে । বছরে ঐ একটাদিন  তুমি সম্বচ্ছরের স্নান করবে ;  চন্দন, অগুরু আর ১০৮ কলসের জল ঢালা হবে, তোমার মাথায়। সেই সাথে তোমার দামড়া দাদাটা আর ছোট বোনটার মাথাতেও।  ঐ জম্মের বুড়ি কম্ম! একদিনে বহু স্নান! বুঝি না কি আর? সব লোক দেখানো। সব প্রাপ্তিযোগের আশায়। তার চেয়ে বাবা আমি রোজ দু-মগ গায়ে ঢালি। আমার দরকার নেই অমন স্নানে।"
জগাদা আর থাকতে না পেরে বললেন, "আহা আমাদের তিন ভাইবোনের কি আর তোমার মত সোনার অঙ্গ? আমরা তো দারুব্রহ্ম, জানোতো তুমি! এসব পুরোণো কাসুন্দি ঘেঁটে কি লাভ তোমার?"
"দারুব্রহ্ম না হাতি! গর্ভগৃহে  কাঠের পুতুল হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রোজ রাতে একটু আধটু দারুও চলে তোমাদের। সে কি আর জানিনা ভাবো?"
"নাগো বিমলা, না। আমরা খাইনা। বলুদাদা খায় শুধু। আমারা ঘুমিয়ে পড়ি গল্প করতে করতে। তারপর দাদা আর বোন ঘুমোলেই আমি টুক করে চুপিচুপি তোমার কাছে চলে যাই" 
  "তোমাদের এই  বার্ষিক স্নানকৃত্যর অদিখ্যেতা দেখলে আমার যে কি হাসি পায় বাপু !“
একপাল লোকের সামনে দিয়ে স্নান করতে যাবে চারজনে মিলে। তোমরা তিন ভাইবোন আর সুদর্শন। খোলা স্নানবেদীতে দাঁড়াবে চারজনে। আর অতজোড়া চর্মচক্ষু গিলবে তোমাদের্! তোমাদের আর কি! ন্যাংটার নেই বাটপাড়ের ভয়!  তোমার শুভ জম্মোদিন বলে কতা! রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন কি চালাকই না ছিলেন! সারাবছরের ঐ একটি দিনে মন্দিরের তহবিলে বেশ ভালোরকম আমদানী হয়। নাম দিয়ে বসলেন, চন্দন যাত্রা, স্নান যাত্রা, রথযাত্রা, দোলযাত্রা .. " বিমলা বলল।

তারপর একশো আট কলসীর পুণ্যজল, শুভজল, ভালো জল, পবিত্র জল,  বিশুদ্ধ জল সব একে একে তোমাদের মাথা থেকে সর্বাঙ্গে ঢালা হয়। সুকুমার রায়ের অবাক জলপানের মত যেন অবাক জলস্নান! তারপর সকলে পরবে হাতির মুখোশ। একে বলে গজবেশ। গণেশকে একটু মান্যি করলে আরকি! বিমলিপিসির  কোলের ঐ ছেলেটার পুজো না হলে কোনো শুভ কাজ হয়না যে ।
তারপর বাবুদের জ্বর আসবে। সত্যি সত্যি আসবে কি না জানিনা, তবে জ্বরের ভান করে, জরজর থরথর অঙ্গ নিয়ে  চারমূর্তি মচ্ছিভঙ্গ হয়ে পড়ে থাকবে ঘরের কোণে।
"পূর্ণিমার তিথিতে অমন ভয়ানক স্নান করলে জ্বর আসবেনা? একে প্রবল তিথি তায় আবার সম্বচ্ছরি স্নান! ব্যথায় বেদনায় কাবু তো হবই"...  জগাদার গলায় অভিমানী সুর। রোজ রোজ স্নান করতে দেবেনা, কাঠের শরীর ক্ষয়ে যাবে বলে। আর যেদিন স্নান করাবে সেদিন এমন স্নান করাবে যে তেড়ে জ্বর এসে যাবে আমাদের্! মা বলতেন" তাত সয় তো বাত সয়না!"  আমি বাপু তাই এই এত জলটলে স্নান করতে নারাজ। 

 তোমাদের আবার প্যারাসিটামল চলেনা!   তারপর রাজবৈদ্য আসবে। এই সময় কেউ তাদের মুখ দেখবেনা। তারপর রাজবৈদ্যের প্রেসক্রিপশান অনুযায়ী এক আয়ুর্বেদিক পাঁচন প্রস্তুত হবে।  এক পক্ষকাল সেই পাঁচন খেয়ে তেনারা জ্বর থেকে মুক্তি পাবেন!   "অনসর" বলে এই সময়টাকে।  বিমলিপিসি বললেন । 

স্নানযাত্রা কাটতে না কাটতেই রথযাত্রা বাম্পার মোচ্ছব! শুধু ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকলেই হবে?  পেজ থ্রি কাঁপাও জগাদা তিন ভাই-বোনে মিলে। বোল্ড এন্ড বিউটিফুল সুভদ্দোরার বেদিং বিউটি পাবলিক গিলবে খুব। লুফে নেবে প্রিন্ট মিডিয়া। তোমার হান্ডি উপচে পড়বে..  প্রচুর এড পাবে এই স্নানযাত্রা মহাযজ্ঞে।    যাও জগাদা, বিমলিপিসিকে নিয়ে একটা সেলফি তুলে ফেসবুকে পোষ্টাও। উড়িষ্যা তথা সারাদেশের ব্র্যান্ড এমবাস্যাডার তুমি। নিজের ব্যান্ড নিজেই বাজাওগে। স্নানযাত্রার আগের রাতেই পাবলিককে স্টেটাস আপডেট করে জানিয়ে দাও "আগামীকাল আমাদের মহাস্নান, অল আর ওয়েলকাম! একবার ছেড়ে দিলে সোনার গৌর আর তো পাবেনা! অতএব শুভস্য শীঘ্রম্‌!"

(কলকাতা -২৪x৭)