Tuesday, April 18, 2017

একে তো পচাভাদ্দর, তালেরও সময়!




বর্ষাকালে বাঙালীর অনেক প্রেমের মধ্যে "তাল প্রেম'ও উথলে ওঠে। এ তাল তালবাদ্যের সাথে যুক্ত নয় কিন্তু মাধ্যাকর্ষণের সূত্র মেনে গাছে পেকে গেলেই তার মুক্তছন্দে পতনের শব্দ যারা পেয়েছে তারা আশাকরি বুঝবে যে তাল পড়ার সে শব্দটা ঠিক কেমন। যাদের তাল গাছ আছে তারা খুব হুঁশিয়ার সে পতনের ব্যাপারে। কারণ সাথেসাথে "ওরে গিয়ে দ্যাখ টাইপ অবস্থা' কারণ তাল কুড়োতে হয় নয়ত তালরসে বঞ্চিত হতে হয়। যারা এই তালের গন্ধ সহ্য করতে পারেনা তাদের অবস্থা খুব সঙ্গীন। যেন ইঁদুর কিম্বা ছুঁচো মরেছে টাইপের। তারা বলবে, কি এমন ফল একটা! তোমরা বাপু তিলকে তাল করতে ওস্তাদ।
আমজাম বাকী ফল গেল রসাতলে, ফাঁকতালে মজতে পারো, প্রেম দেখাতে তালে!

আমি বলি তালেগোলে হরিবোলে উতলধারায় মিশিয়ে দাও তালরস ।

শ্রাবণ-ভাদ্রে দেখা পাওয়া যায় এই তাল নামক সুস্বাদু বর্ষাকালীন ফলটি। যার রসে টইটুম্বুর অন্তর পেরোতে হবে শ্বশ্রুগুম্ফ সম্বলিত এক সত্ত্বাকে সামলিয়ে । তালের বৈশিষ্ট্য এইটাই। বাইরে গোবেচারা ভেতরে সন্ন্যাসী। সেই জটাজুটসমাযুক্তকে বসন শূন্য করতে যাওয়াটাই হল একটা প্রজেক্ট। যত খোলো তত সুতো। যেন চরকার সব সুতোর প্রলেপ তার শরীরে। মনে মনে গেয়ে উঠি "তারে বহু বাসনায় স্ট্রিপ করে যাই, তবুও আঁটির নাগাল না পাই'
তাল বাড়িতে এলে গৃহিণীর দু নয়নে শাওনভাদো । অবস্থা কাঁদো কাঁদো ।

ঘষতি ঘষতি অঙ্গ, পুনঃ তায় দিয়ে পানি,
কাজের মাসী ভাবে বসে...
কখন যে বাপু নিজের ঘরে তাল ছাঁকব তা জানি ?

তালগাছ বিবর্জিত শহরে রবিঠাকুর বেঁচে থাকলে তালগাছ নিয়ে তাঁর কবিতার আবেগ চাপা পড়ে যেত। অথবা ছেলের সম্বন্ধ করতে গিয়ে ঠাকুমা দিদিমারা বলতেন না "নামেই তালপুকুর, ঘটি ডোবেনা' । এমন তালপুকুর দেখেই রবিঠাকুর তালদীঘিতে বুঝি কেয়াপাতার নৌকো ভাসানোর গান লিখেছিলেন।

প্রাচীনযুগের মুনিঋষিরা লিখতেন তালপাতায় খাগের কলম কালিতে ডুবিয়ে। সকলের কাছেই তাঁদের সাহিত্যসৃষ্টির হার্ডকপি ছিল এই ভূর্জ্যপত্র।

ভাদ্রমাসে শুক্লা নবমী তিথিতে অনেক মহিলা "তালনবমী' ব্রত করেন । নারায়ণকে নিবেদন করে তবেই তাল খাওয়ার রীতি। এই তালনবমীর ব্রতকথা যেন টেলিভিশনের মেগা সিরিয়ালের মত‌ই । শুধু কুশীলব হলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ আর তাঁর দুই প্রিয়তমা সপত্নী...সত্যভামা ও রুক্মিণী। তালের রসে স্বামীকে বশীকরণ । ঐ আর পাঁচটা মত‌ই এর সুফল হল সৌভাগ্য লাভ, সুখবৃদ্ধির মত‌ই। তবে এয়োস্ত্রীরাই কেবল করতে পারবেন কেন তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সংশয়। জগত সংসারে কি তবে যত দুঃখ এদেরি ? বাকী আইবুড়ো, বিধবা কিম্বা নিঃ সন্তান অথবা সিঙ্গল মাদারদের কি সুখ, সৌভাগ্যের প্রয়োজন নেই?

শ্রীকৃষ্ণের হ্যাপি বার্থডের পরদিন নন্দোত্সবে ভক্তরা আনন্দে নাচতে থাকে আর গেয়ে ওঠে..."তালের বড়া খেয়ে নন্দ নাচিতে লাগিল'

এ যেন ঈশ্বরের সাথে একাত্ম হয়ে তাঁর প্রিয় ফলটি নিবেদনের মধ্যে দিয়ে ভক্ত আর ভগবানের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করা। তাঁর জন্মদিন যেন আমাদের ঘরের ছেলেরি জন্মদিন।

হে কৃষ্ণ করুণাসিন্ধু ! তালের বড়া দিতে পারি, যদি পার কর এই ভবসিন্ধু।
হ্যাপি বার্থডে অন্তর্যামী ! তালের বড়া সাজিয়ে দিলাম, এবার খাবেন আমআদমী !

এই তালের বড়াকে অনেকে তালের ফুলুরিও বলেন। রসরাজ অমৃতলালের লেখায় পাই এই তালফুলুরির কথা।

তালফুলুরির তত্ত্বে করিয়া জমক, ধার্য হল লোক মাঝে লাগাবে চমক।

কথায় বলে না ? ও তাল তুলনি বাপু! যার অর্থ হল তাল বাড়িতে এলে যা হ্যাপা সামলাতে হয় তা যিনি সামলান তিনিই জানেন।
এমনকি রসরাজ বলছেন, বেশী তালের বিপদ।
ফুলুরি খাইলে যদি পেটে ধরে ব্যথা, পেপারমেন্টো দিতে হবে নাহিক অন্যথা।

এর থেকে বোঝা যায় বাঙালীর সেযুগে তালবিলাসের কথা।

আমি বাপু বড় তালকানা। তালকাহন নিয়ে টালবাহানা না করে লিখে দিলাম। আমি তেমন কোনও তালেবর নই। যে কথা জানিনা আর শুনিনি তা নিয়ে তিল থেকে তাল বানাতে পারিনা তাই মাফ চেয়ে নিলাম পাঠকের কাছে। আকাশ পাতাল ভেবে তালের গন্ধে মাতাল হয়ে তাল নিয়ে সাতকাহন লিখলাম। এবার দাঁতাল কোনও পাঠক যদি নিন্দে মন্দ করেন তাকে নাহয় রেঁধে খাওয়াতে পারি এই তাল। আমার হেঁশেলে আজ হরতাল। দিনেরাতে সকলেই খাবে শুধু তাল।

যাই দেখি আমার চাতালে তাল ছাঁকার সুগন্ধে বুঝি হরিতাল পাখিটা এয়েচে! যদিও বেতালে ডাকছে তবুও আমি তাল দিয়ে চলি ওর সাথে। 

গুরু না ভজিলে


কাল সকাল বন্ধু রমেনকে ফোন করতে গিয়ে কলারটিউনটা শুনেই মাথাটা গরম হয়ে গেল কর্তার
"দিন তোমার আনন্দে যাবে জপলে গুরুর নাম....ভাই জপো, জপো গুরুর নাম, জপো জপো গুরুর নাম..." একবার, দুবার, বহুবার.....যেন শুনিয়েই ছাড়বে  গুরুবন্দনা। 

টেলিভিশন চ্যানেলে সঙ্গীতশিল্পীরা গান শুরু করার আগে গুরুর নাম করেই সর্বাঙ্গ ছুঁয়ে ক্ষমাপ্রার্থী আজ। কেন রে বাবা? এই গুরুমুখী বিদ্যের জন্য ভারতবর্ষের আর কিছুই হচ্ছেনা আর। নতুন কিছু কর বাপু! গুরুশিষ্য পরম্পরায় পড়ে থাকলে নিজের ক্রিয়েটিভিটির পরিস্ফূরণ হবেনা দেখিস। কর্তার ভারি রাগ হচ্ছে। মাঝেমাঝেই গিন্নীর পানে ছুঁড়ে দিচ্ছেন এক আধটা ক্রোধ-ফুলকি! 
সারা দেশের আনাচকানাচে আজ একটাই সুর ......
 "গুরু ব্রহ্মা, গুরু বিষ্ণু, গুরুর্দেব মহেশ্বর, গুরু সাক্ষাত পরমব্রহ্ম তস্মৈ শ্রী গুরবে নমোহঃ"
...একেই ঈদ, রথযাত্রা, বিপত্তারিণীর কৃপায়  মাগ্যিগন্ডার ফলপাকড়ের বাজারটা সবে একটু কমতির দিকে....তারপরেই গিন্নীমায়েরা ছুটলেন আবার বাজারে....গুরুপূর্ণিমা বলে কতা ! সেই কবে দীক্ষে দিয়ে গুরু গিন্নীর জেবনটাই বদলে দিলেন গো! 
গিন্নী পরম ভক্তিতে গুরুর পুজো করছেন আজ।  একপ্রস্থ হবে বাড়িতে, বাকীটুকুনি হবে গুরুর আশ্রমে। রীতিমত জম্পেশ পটলাক পার্টি।
ঠাকুরঘর থেকে ভেসে এল গানের সুর..

শিষ্য মেলে কতশত, গুরু মেলে একজনা,
সেই গুরুর চরণ পেলে পাপীর দেহ হয় সোনা.....

-বোঝো কান্ড! তাহলে আমাকে বিয়েশাদী কল্লে কেনো? কর্তা বল্লেন গিন্নীকে। 
গিন্নী আবার গেয়ে উঠলেন..

গুরু ব্রহ্মা, গুরু বিষ্ণু, গুরু মহেশ্বর
গুরুতত্ব জেনে তবে আসল গুরু ধর
গুরু আমার পথের আলো,
তাঁরে সব সঁপে দেনা !

কর্তা এবার ঝেঁঝে উঠে বল্লেন,
-তাহলে থাকো তোমার গুরুকে নিয়ে। আর শোনো, আমার ঐ মাথার ঘাম পায়ে ফেলা টাকাগুলো দিয়ে গুরুসেবা এবার বন্ধ করো দিকিনি।  ফিবছর আষাঢমাসের এই দিনটাতে গুরু গুরু করে এক্কেরে দরদ উথলে উঠছে। ধম্ম কচ্চেন তিনি! গৃহধর্মটা ঠিকঠাক পালন করোতো বাপু। আমার মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে এলাম।আর উনি পড়ে র‌ইলেন কিনা গুরু নিয়ে।
ভুরি ভুরি মিথ্যে কথা বলছ্, মানুষের মনে দুঃখ দিচ্ছ, অন্যকে ঈর্ষা করছো, ঠিক দীক্ষা নেবার আগে যেমন করতে, তাহলে দীক্ষা নিয়ে কি হল বাপু?  বলি গুরু তোমার কি উন্নতি করলো শুনি? 

গিন্নী নাক টিপে গুরুর দেওয়া একশোআট রুদ্রাক্ষের মালাটা  গলায় ঝোলানো জপের ঝুলি থেকে আদ্দেকটা বের করে নাম জপ করছিলেন। তাই কথা বলা বন্ধ তার। শুধু আড়চোখে দেখে নিলেন কর্তার দিকে একটিবার। 
কর্তা বল্লেন,
-প্রথমে  সংস্কৃত স্তোত্র দিয়ে গুরুবন্দনা হল। তারপর গুচ্ছের গান গেয়ে গুরুস্তুতি হল, এবার শুরু হল নাক টিপে গুরুর নাম জপা।  আজ আবার তেনার উপোস। তাই আমারো কপালে ভাত ডাল জুটবেনা। উনি গুরুর আশ্রমে যাবেন প্রসাদ পেতে আর আমি পাঁউরুটি খেয়ে আপিস করব সারাটাদিন। আর আমার পয়সায় গুরু গিলবেন চর্ব্য-চূষ্য-লেহ্য-পেয়!
...মাখন দিয়ে মিছরি, কাগচি বাদাম, পাথরের গেলাসে দৈযের ঘোল, পাঁচরকম সেরা ফল যেমন বেদানা( আমার বড়োই বেদনা হয় দাম শুনে), ঋতুশেষের মহার্ঘ্য আম( শালা নিজে খাইনা আর), কাশ্মীরি আলুবখরা( চেখে দেখলামনা আজো), আরবী খেঁজুর( দানা ছোট বলে নাকি স্বাদে অতুলনীয়), কালো আঙুর( গুরুদেবের নাকি রক্তাপ্লতা আছে, প্রায়শ‌ই উপোস করে থাকেন তো)!
সেই সঙ্গে উত্কৃষ্ট সব মিষ্টান্ন। সেনমশাইয়ের "বাবুসন্দেশ", যাদবচদ্র দাসের "আবার খাবো", ভীমনাগের "রাতাবী", যুগলের "দিলখুশ", বলরাম মল্লিকের "জলভরা", অমৃতের পয়োধি, মহাপ্রভুর কেশর রাবড়ি....আরো কত কি! 

-গুরুপূর্ণিমে পালন হচ্চে! গুষ্টির তুষ্টি হচ্চে! সংসারটা ঠিকমত করো দিকিনি। তা না সারাবছর গুরুভাইবোনেদের সাথে আজ এখানে, কাল সেখানে যাচ্চি, ফূর্তিফার্তা করচি আর সংসারধর্ম চুলোয় দিচ্চি। স্বামী রোজ বিকেলে বাড়ি ফিরে তেনার কাপড় তুলছেন বারান্দা থেকে। নিজে চা করে খাচ্চেন সারাদিন পর আর খিদে পেলে সেই একগ্গাল মুড়ি চিবিয়ে পড়ে আচেন। আর উনি কচ্চেন ধম্মকম্মো! নিকুচি করেচে!  শ্বশুরশাশুড়িকে জম্মে দিলনা দানাপানি আর গুরুর পুজোয় রূপোর রেকাব, ফলের ঝুড়ি, সাজিয়েগুছিয়ে চল্লেন উনি!  

গুরুসেবা কত্তে। ধম্ম যেন ফ্যাশন হয়েছে এখন। কোথায় গুরু লেকচার দিচ্ছেন্, ছোট, ছোট সেখানে। দরকার হলে গাড়ি ভাড়া করে হৈ হৈ করে এক দঙ্গল নিয়ে ছোট। কোথায় গুরুর ত্রাণ তহবিলে চাঁদা তুলতে হবে, সব কাজ শিকেয় তুলে পাড়ার দোরে দোরে ঘোর....কি না, গুরুর কৃপা দৃষ্টি পেতে হবেনা! না পেলে মোক্ষলাভ হবেনা যে! 

এত্তসব সলিলকি আওড়ে কর্তার মনে হল গিন্নীকে আজ একটা দাওয়াই দিয়েই ছাড়বেন তিনি। হঠাত মনে পড়ল তার নিজের মায়ের কাছে শোনা গুরুপূর্ণিমার বেত্তান্তের কথা। গিন্নী পুজোর ঘর থেকে বেরোলেই কর্তা তাকে জিগেস করে বসলেন
"আচ্ছা, এত তো গুরুপূর্ণিমার জন্য প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে, জানো কি আসলে গুরুপূর্ণিমাটা কেন পালন করে? "
গিন্নী বলল, জানতাম, ভুলে গেছি।
কর্তা বলল, জানতেও না, জানবার চেষ্টাও করোনি কোনোদিনো। ধর্মপালন নিয়ে পুতুল খেলা করলে কি আর জ্ঞান বাড়ে?
গিন্নী বলল, বাজে কথা রাখো। আমার আজ আশ্রমে যেতে হবে। তার আগে জলখাবার বানাতে হবে।
কর্তা বলল, তোমার তো উপোস আর আমার তো বরাদ্দ চা-পাঁউরুটি আজ। 
গিন্নী বলল, লুচির ময়দা মাখতে হবে, যেতে দাও।
কর্তা বলল, "যাক তবে, গুরুর জন্যে আজ তবু বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে। জামাইয়ের জন্য মারি হাঁস, গুষ্টিশুদ্ধ খায় মাস" 
গিন্নী বলল, আশ্রমে পেসাদ পেতে অনেক বেলা হয় যে। বাবার ভোগ নামবে তবে তো খাব সকলে।
কর্তা বলল, যাক এমন ভোগ যেন প্রতি বছর অনেক দেরী করেই নামে।

কর্তার মনটা একটু খুশ হল অনেকদিন বাদে জলখাবারে লুচির কথা শুনে...জানো গুরুপূর্ণিমা আসলে কার হ্যাপি বার্থডে?
গিন্নী বললে, সে জানি, মহাভারতের রচয়িতা মহর্ষি ব্যাসদেবের , তাই তো এর আরেক নাম ব্যাসপূর্ণিমা। কর্তা বললেন, ভেরি গুড, আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ ডিয়ার!  কিন্তু  আমার খুব আপত্তি এতে।
গিন্নী বলল, কেন শুনি?
আরে যিনি রক্ষক তিনি‌ই ভক্ষক যে।
মানে?
মানে, মহাভারত নিজের গুষ্টির কাজিয়া তাই তিনি ছাড়া আর কে এমন ভালো করে জানবেন তার কাহিনী? তাই তো তিনি অত গুছিয়ে লিখতে পেরেছিলেন। নয়ত অত চরিত্র নিয়ে অমন একটা মহাউপন্যাস কেউ সহজে লিখতে পারে বলো? 
গিন্নী লুচির ময়দা ঠাসতে ঠাসতে বলল, নিজের গুষ্টি বললে কেন?
কর্তা বলল,  
মহাভারতের গ্রন্থকার প্রবাদপ্রতিম পুরুষ কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ ব্যাসদেব  ছিলেন মহর্ষি পরাশর এবং মৎস্য কন্যা অবিবাহিতা সত্যবতীর অবৈধ সন্তান । আর গঙ্গার মৃত্যুর পর ব্যথিত, পথক্লান্তিতে পরিশ্রান্ত রাজা শান্তনু যখন সত্যবতীকে বিয়ে করতে চাইলেন  তখন  সত্যবতীর একমাত্র শর্ত ছিল এই যে, শান্তনু এবং তার প্রথমা পত্নী গঙ্গার পুত্র  দেবব্রত ভীষ্ম কোনো দিনও যেন বিবাহ না করেন । তাহলে সত্যবতী এবং শান্তনুর বংশধরেরাই হবে ঐ রাজবংশের উত্তরসুরী ।  আর কারো কোনো দাবী দাওয়া থাকবে না।  ভীষ্ম তাই ছিলেন চির কুমার ।   কিন্তু অচিরেই যখন শান্তনুর মৃত্যু হল এবং সত্যবতীর সোনার সংসারে নেমে এল একরাশ অসহায়তা তখন সেই ভীষ্মই হলেন রাজমাতা সত্যবতীর আজ্ঞাবহ দাস । কত বড়  সুযোগসন্ধানী এই মহিলা !
শান্তনু-সত্যবতীর দুই পুত্র হল চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য । শান্তনু অকালে মারা গেলে প্রথমে চিত্রাঙ্গদ ও তার মৃত্যু হলে বিচিত্রবীর্য সিংহাসন আরোহণ করলেন । নাবালক বিচিত্রবীর্যের জন্য পাত্রী সেও সংগ্রহ করে এনে দিলেন ভীষ্ম ।  কারণ সত্যবতীর হুকুম আর সেই বংশরক্ষার ছড়ি । দুই পত্নীর ভর্তা হয়েও বিচিত্রবীর্য যখন অকালে প্রাণ হারান তখন  সেই দুই পুত্রবধূর গর্ভসঞ্চারের জন্য সত্যবতী ভীষ্মকে লোকদেখানো একটা অনুরোধ করলেন ঠিকই কিন্তু হার মানলেন পুরুষ সিংহের প্রতিজ্ঞার কাছে । বরং ভীষ্মই তাকে পরামর্শ দিলেন সে যুগের রীতি অনুযায়ী ক্ষেত্রজ পুত্রোত্‌পাদনের কথা বলে ।  সত্যবতীর কুমারী জীবনের পুত্র সেই ব্যাসদেবকেই আহ্বান করা হল বীজ বপনের জন্য ।পুত্রও প্রস্তুত বীজ বপনের জন্য মাতৃ আজ্ঞা নিয়ে আর  দুই বিধবা পুত্রবধূর উর্বর ক্ষেত্রও প্রস্তুত মাতৃত্বের হাহাকার নিয়ে ।অতএব  ব্যাসের ঔরসে বিচিত্রবীর্যের দুই পত্নীর ধৃতরাষ্ট্র এবং পান্ডু নামে দুটি প্রতীবন্ধী পুত্রের জন্ম হল । শোকার্ত দুই পুত্রবধূর ওপর শ্বশ্রুমাতা সত্যবতীর আরোপিত এই আদেশ নিন্দনীয় হলেও সত্যবতীর স্বীয় বংশ বিস্তারের খিদে তো মিটলো ! সেদিক থেকে বিচার করলে শান্তনুর রক্ত কিন্তু টিঁকে র‌ইল না ।  কৌরব-পান্ডব উভয়পক্ষের সাধারণ প্রপিতামহী রাজমাতা সত্যবতীর অবৈধ সন্তান মহর্ষি ব্যাসদেবের সেই রক্তস্রোত  প্রবাহিত হল মহাভারতের দুই নায়ক ধৃতরাষ্ট্র ও পান্ডুর মধ্যে দিয়ে।  যদিও ব্যাসদেব তার মাতা সত্যবতীর কানীন পুত্র তবুও বংশরক্ষার দায়িত্ববান পুরুষ হিসেবে মহাভারতে তার অবদানকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই ।
ব্যাসদেবের কুত্‌সিত চেহারার জন্য বিচিত্রবীর্যের দুই পত্নীর দুটি প্রতিবন্ধী পুত্র হল ঠিকই কিন্তু  যদি তারা আবার বংশরক্ষায় সক্ষম না হন সেই কথা ভেবে রাজবাড়ির দাসীর গর্ভ সঞ্চার করলেন ব্যাসদেব । ফলে জন্ম নিলেন সুস্থ দাসীপুত্র বিদুর যার পিতামহীও স্বয়ং সত্যবতী ।  বিচিত্রবীর্যের দুই পত্নীর দুটি প্রতিবন্ধী পুত্রের পিতা ব্যাস কিন্তু কখনো নিজেকে তাদের পিতা বলে পরিচয় দেন নি । কেননা তারা তো বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রজ । কিন্তু এই দাসীপুত্র বিদুরের পিতা তো মহর্ষি ব্যাস । তাই রাজপুত্র দ্বয়ের চেয়ে দাসীপুত্রের ওপরই ছিল তার অগাঢ় অপত্য স্নেহ । মহাভারতের পাতায় পাতায় আমরা ব্যাসদেবকে মহামতি বিদুরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে দেখেছি । ব্যাসদেব স্বয়ং মহাভারতের রচয়িতা বলেই বোধ হয় তাঁর এরূপ পক্ষপাতিত্ব । আর কুন্তীর ক্ষেত্রজ সন্তানদের মধ্যে যুধিষ্ঠির যে ঐ বিদুর বা ধর্মপুত্র তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।  
বিশেষত যুধিষ্ঠিরকেই তিনি সর্বোত্তম বলে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন । এর কারণ একটাই ; পান্ডুর সবকটি ক্ষেত্রজ সন্তানের মধ্যে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের পিতা ছিলেন ধর্মপরায়ণ ন্যায়নিষ্ঠ বিদুর ব্যাতীত আর কেউ নন সেটা অন্যদের কাছে গোপন থাকলেও সত্যবতী, কুন্তী আর বিদুর ছাড়া ব্যাসদেব নিজে যে জানতেন সে কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা ।   আর সেই জন্যই যার হাতে র‌ইল কালজয়ী ইতিহাস রচনার কলম  তিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জেতাতে চাইলেন সেই পান্ডবদের । প্রতিষ্ঠা করলেন  যুধিষ্ঠিরের আদর্শবাদ আর সত্যবাদীতাকে ।
ব্যাসদেবের কলমের কারসাজিতে পাঠক বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছেন  যে ধৃতরাষ্ট্রকে সত্‌পরামর্শ দিয়ে ঠিক পথে চালিত করছেন এই ন্যায়নিষ্ঠ দাসীপুত্র । কিন্তু আসলে  পক্ষপাত দোষেদুষ্ট এই বিদুর নামের রাজনীতিবিদের সম্মোহনী শক্তিতে পরাস্ত হয়েছেন ধৃতরাষ্ট্র । এ যেন "চোরকে বলে চুরি করো আর গেরস্তকে বলে সাবধান হও" এই ভাবে ধীরে ধীরে মহারণের দাবার ঘুঁটিকে পাকাপোক্ত ভাবে নিজের দিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা ।  লক্ষ্য একটাই ; নিজের পুত্র যুধিষ্ঠিরকে সিংহাসনে বসিয়ে দেওয়া ।
অতএব এবার তোমার ক্লিয়ার হল তো ব্যসদেব স্বয়ং নিজের গুষ্টির গল্পটা কেমন ফেঁদেছিলেন ঐ মহা-উপন্যাসে? 
যাও যাও গিন্নী, আজ একটা বিশাল বার্থ-ডে কেক নিয়ে যাও তোমার গুরুর জন্য!!!  ভারতবর্ষের আদিগুরুর জন্মদিন বলে কতা! 

Wednesday, April 12, 2017

স্বর্গীয় রমণীয়ঃ নীল ষষ্ঠী

স্বর্গীয় রমণীয় ()
নীল
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

মহাদেবের নীলের পুজোর দিনটা বরাদ্দ চড়ক বা গাজনের দিনক্ষণ অনুযায়ী, বর্ষশেষের সংক্রান্তির আগের দিনে। প্রতিবছর এই নিয়ে দুগ্গার সঙ্গে শিবের বেশ ঠান্ডা লড়াই চলে। দুর্গা ও ষষ্ঠীর অংশ, সে কথা কে আর না জানে? আর শিবের ফন্দীও কি দুগ্গার জানা নেই?
হঠাত দুগ্গা বলল, 'দিন আগেই তো ঠান্ডায় ঠান্ডায় শিবরাত্তিরে মহা ধূমধাম করে কত্ত পুজো পেলে । ফাগুনদিনের মাগ্যির বেলের পানা, তরমুজ, ফুটি খেয়ে পথ্যি করলে। সিদ্ধি-মধু-ঘিয়ের ফেসপ্যাক নিলে । ডাবের জলে মুখ আঁচালে । ঠান্ডার পর নতুন গরমে কাগচীলেবুর সুবাস ছড়ানো টক দৈয়ের ঘোল খেয়ে ব্যোম্‌ ব্যোম্‌ করে ত্রিভুবন শান্তি কল্লে । মাথা ঠান্ডা তো তোমার গুরু! আবার নীলষষ্ঠী ? ষষ্ঠী তো এতদিন জানতাম একবগ্গা মেয়েদের সম্পত্তি। এবার সেখানেও ভাগ বসালে তো আমাদের ব্র্যান্ড ডাইলুশান হয়।

শিব বলল, নিজের আত্মতুষ্টিতে বিভোর তুমি। জানবে কি করে প্রজারঞ্জনের মাহাত্ম্য?
আবার ষষ্ঠীর পেছনে নীল জোড়া কেন বাপু? ক‌ই আমরা তো লাল,সবুজ, হলুদ ষষ্ঠীর দোহাই দি‌ই না মানুষকে।
পাশ থেকে সাওকড়ি মেরে নন্দী বলল, মা ঠাকরুণ তো ঠিক‌ই বলেচে বাবা।
নীলষষ্ঠী নীল কেন ? লাল বা সবুজ নয় কেন?
নীল কথাটি নীলকন্ঠ মহাদেবের সাথে সাযুজ্য রেখে... এতদিন আমার কাছে আচিস এটাও জানিস নে? মহাবাবা বলেন । সেই যে সেই সমুদ্রমন্থনের সময় আমি দুনিয়ার সব বিষ আমার কন্ঠে ধারণ করেছিলাম । তাই তো সকলে আমাকে নীলকন্ঠ বলে ডাকে রে ।
তার সঙ্গে ষষ্ঠী জুড়লো কে বাবা ? নন্দী বললে
তাহলে শোন্‌ বলি: মহাদেব শুরু করলেন।
এক বামুন আর বামনীর পাঁচছেলে আর দুটি মেয়ে । ( ফ্যামিলি প্ল্যানিং তো আর ছিলনা সে সময়ে )
তারা খুব পুজোআচ্চা করত । কিন্তু এত পুজো, বারব্রত করেও তাদের সব ছেলেমেয়েগুলো একে একে মরে গেল । তখন বামনীর ঠাকুরদেবতায় বিশ্বাস চলে গেল । তাদের আর সেই জায়গায় থাকতেও ভালো লাগল না । বামুন-বামনী ঠিক করল সব ছেড়েছুড়ে তারা মনের দুঃখে কাশীবাসী হল । দশাশ্বমেধ ঘাটে স্নান করে অন্নপূর্ণার পুজো করে মণিকর্ণিকার ঘাটে বসে আছে , এমন সময় মা-ষষ্ঠী বুড়ি এক বামনীর বেশে এসে বললে " কি ভাবছ গো মা?" বামনী বললে " আমার সব ছেলেমেয়েদের হারিয়েছি । এত পুজোআচ্চা সব বিফলে গেল আমাদের । সব অদৃষ্ট। ঠাকুর দেবতা বলে কিছ্ছু নেই । "
ষষ্ঠীবুড়ি বললেন " বারব্রত নিষ্ফল হয়না মা, ধর্মকর্ম যাই কর ঈশ্বরে বিশ্বাস চাই । তুমি মা-ষষ্ঠীকে মানো? তাঁর পুজো করেছ কখনো? তিনি সন্তানদের পালন করেন । বামনী বললে " আমি এযাবতকাল সব ষষ্ঠী করে আসছি কিন্তু তবুও আমার ছেলেরা র‌ইল না ।
ষষ্ঠীবুড়ি বললেন্" তুমি নীলষষ্ঠীর পুজো করেছ কখনো? চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন উপোস করে শিবের পুজো করবে । শিবের ঘরে বাতি জ্বেলে জল খাবে । সন্তান্‌দের মঙ্গলকামনা করবে' (স্পিরিচ্যুয়াল গুরুদের ব্ল্যাকমেইলিংয়ের একটা লিমিট থাকে, তখন ছিলনা)
বামনী সেই কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে পুনরায় মাতৃত্ব লাভ করলে ।

নন্দী সব শুনে বললে" বাবা, এ তো তবে তোমার নিজের ব্র্যান্ড ক্রিয়েট করলে তুমি । আর সব ষষ্ঠীর পুজোয় তো মাষষ্ঠীর পাল্লা ভারী হয়ে যাচ্ছিল তাতে যদি তোমার নামডাকে ভাটা পড়ে তাই বুঝি এমনটি কল্লে তুমি?'
মহাবাবা বললেন " দেখ নন্দী, এখন যা যুগ এয়েচে তাতে নিজের ব্র্যান্ড যে মূল্যেই হোক ক্রিয়েট করতে হবে । নয়ত তুই স্থান পাবিনা জগতে , যা কম্পিটিটিভ মার্কেট এয়েচে! লাখলাখ দেবদেবীর ভিড়ে মহাদেবকে কেউ আর মানবেনা ।
নন্দী সব শুনে বললে "বাবা, আর সব ষষ্ঠীর পুজোয় তো মা-ষষ্ঠীর ওরফে মা দুর্গার পাল্লাটা একটু বেশী ভারী হয়ে যাচ্ছিল তাতে যদি তোমার নামডাকে ভাটা পড়ে তাই বুঝি এমনটি কল্লে তুমি?'
মহাবাবা বললেন " মেয়েরা তথা দেবীরা যা হুজ্জুতি শুরু করেচে তাতে দেবেরা আর পাত্তা পাবেনা বুঝলি? কোন্‌ দিন বলে বসবে "মাই চ্চয়েস!!!
নন্দী বলল, ঠিক কয়েছ বাবা। সেই দেখে ঊর্বশী-রম্ভা, ওরাও যদি বলে বসে ? "পুজো চাই! মাই চয়েস!!!"
শিব সেই শুনে বললেন, কুদোস নন্দী! এই জন্যে তোর কথায় আমি উঠি আর বসি। তোদের মা তাই বুঝি আমায় জিজ্ঞেস করছিল এতসব। মানে শিব্রাত্তির পরেই কেন আবার নীল... ইত্যাদি, ইত্যাদি।